বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস আলোচনা কর। 

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ  বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ   গ্রামে বাস করে। গ্রামীণ সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস বেশ জটিলও কঠিন প্রক্রিয়া।  এটি গ্রামীণ সমাজের  বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভর করে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে  ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয় । স্বাধীনতার পর  সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।  বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় সামাজিক স্তরবিন্যাসঃ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শহর ও গ্রামভিত্তিক স্তরায়ন লক্ষ করা যায়।

সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিচয়ঃ সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে অর্থ, সম্পদ, মেধা, বংশ, শিক্ষা, বয়স, পেশা, লিঙ্গ, ক্ষমতা ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজের বিদ্যমান জনসংখ্যাকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করা হয়। জন্মসূত্রে সকল মানুষ সমান এমন মানবতাবাদী দর্শন পৃথিবীতে চালু থাকলেও বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন কোন সমাজ পাওয়া যাবেনা যেখানে মানুষে মানুষে পার্থক্য নেই। সামাজিক স্তরবিন্যাস সর্বজনীন। সব যুগে সব কালে সব সমাজই স্তরায়িত।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ

সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞাঃ সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা।। স্তরবিন্যাস এর ইংরেজি প্রতিশব্দ stratification।   বিভিন্ন জৈবিক ও অজৈবিক উপাদানের উপর ভিত্তি করেই সামাজিক স্তরবিন্যাস সংগঠিত  হয়।  সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্স সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞায় বলেন,  সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে সমাজের মানুষের বিভাজন। এ বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েভার বলেছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস তথা সমাজের মানুষের বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে সম্পত্তি, ক্ষমতা ও মর্যাদা। মালভিন টিউমিন এর মতে,সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যাতে একটি সামাজিক গোষ্ঠী বা সমাজ শক্তি, সম্পত্তি, সামাজিক মূল্য ও মানসিক তুষ্টির তাররম্যের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বার্ধ রীতিতে শ্রেণীবদ্ধ হয়।

সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকারভেদ

আধুনিক  সমাজে তিন শ্রেণীর মানুষের ওপর   ভিত্তি করে  সামাজিক স্তরবিন্যাস করা হয়। এই তিনটি শ্রেণি হলো:

  • উচ্চবিত্ত
  • মধ্যবিত্ত
  • নিম্নবিত্ত

বাংলাদেশে গ্রামীণ কৃষক সমাজে পাঁচ ধরনের সামাজিক স্তরবিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। যেগুলো হলো 

১।  জমিদার শ্রেণি,

২। খুদে জমিদার,

৩। মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি,

৪। কৃষক জনগোষ্ঠী এবং

৫। ভূমিহীন কৃষক শ্রমিক শ্রেণি।

এছাড়াও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন ভিত্তি পরিলক্ষিত হয়  যার উপর ভিত্তি করে বর্তমানে সামাজিক স্তর বিন্যাস সংঘটিত হয়ে থাকে আধুনিক সময়ে সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন ভিত্তিগুলো হলঃ  যেমন 

জমিঃ গ্রামীণ সমাজে জমি মালিকানা স্তরবিন্যাসের মূল ভিত্তি।গ্রাম বাংলায় দেখা যায় গ্রামে যে ব্যক্তির জমির পরিমাণ অত্যাধিক বেশি থাকে সে সমাজে সর্বক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বেশি পায়। 

ধনসম্পদঃ ধন সম্পদ সামাজিক স্তরবিন্যাসের অন্যতম মূল হাতিয়ার। সমাজে সেই ব্যক্তির ধন সম্পদের পরিমাণ বেশি  তাকে সমাজের অন্যান্য সকল ব্যক্তিবর্গ সম্মান এবং শ্রদ্ধা  করে থাকে। সমাজ ব্যবস্থায় যেন মান সম্মানের মূল ভিত্তি হলো ধন-সম্পদ ।

পেশাঃ কৃষক, কৃষি শ্রমিক, মৎস্যজীবী, কারিগর, ব্যবসায়ী, শিক্ষক,

শিক্ষাঃ  শিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভাগ

ধর্মঃ ধর্ম সামাজিক স্তরবিন্যাসের অন্যতম বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্মীয় ওই অবস্থানের  উপর ভিত্তি করেই সামাজিক স্তরবিন্যাস করা হয়। হিন্দু সমাজে এটি অত্যাধিক পরিমাণ পরিলক্ষিত হয়। 

বংশঃ বংশ সামাজিক স্তরবিন্যাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্যান্য যোগ্যতা না থাকে সত্বেও শুধুমাত্র   বংশীয় গৌরবের কারণে অনেক ব্যক্তিবর্গ সমাজের উচ্চস্থানে   অধিষ্ঠিত হয়।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নগরায়ন ও  শিল্পায়নের প্রভাব

আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তিত সামাজিক স্তরবিন্যাস হিসেবে তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। যথা:

(ক) শ্রেণি,

(খ) মর্যাদা এবং 

 (গ) ক্ষমতা।

এ তিনটি ধারার আলোকে গ্রামীণ সামাজিক স্তরবিন্যাস নির্ধারিত হয়। নিম্নে এ তিনটির বর্ণনা দেওয়া হলো :

১। শ্রেণিভিত্তিক সামাজিক স্তরবিন্যাসঃ এখানে বিশেষ মর্যাদা ও শ্রেণির উপর ভিত্তি করে স্তরায়ন করা হয়। কার্ল মার্কস এ শ্রেণিভিত্তিক স্তরায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন। গ্রামীণ প্রধান উপকরণ হিসেবে ভূমিকে গণ্য করা হয়। তাই এর ভিত্তিতে স্তরায়ন করা হয়। যথা :

i. ভূমালিক শ্রেণি,

ii. বর্গাদার কৃষক শ্রেণি এবং

iii. ভূমিহীন কৃষক শ্রেণি।

২।মর্যাদাভিত্তিক সামাজিক স্তরবিন্যাসঃ গ্রামীণ সম্প্রদায় সামাজিক স্তরবিন্যাসের মানদণ্ড হিসেবে মর্যাদাকেও বিবেচনা করা হয়। এ মর্যাদা সমাজে দু’ভাবে নির্ণয় করা যায়। যথা :

ক. আরোপিত (Ascribed status) ও

খ. অর্পিত (Achieved status).

৩। ক্ষমতাভিত্তিক সামাজিক স্তরবিন্যাসঃ  গ্রামীণ সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হলো ক্ষমতা বা Power। প্রশাসনিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভিত্তিতে গ্রামীণ সমাজে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে থাকে। স্থানীয় চেয়ারম্যান, প্রশাসক প্রভৃতি ক্ষমতাবলে মর্যাদা পেয়ে থাকে ।

আরো পড়ুনঃ Previous Brief Sociology of Bangladesh

উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে,  গ্রামীণ সমাজের স্তরবিন্যাস দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। বিভিন্ন চড়াই-উতরাই এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সামাজিক স্তরবিন্যাস সংঘটিত হয়েছে । এখানে নানা শাসকগোষ্ঠী নানা সময়ে শাসন করেছেন যা  সামাজিক কাঠামোতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী প্রকৃতির প্রভাবে আমাদের সামাজিক স্তরবিন্যাসের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে।  

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263