ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণসমূহ

ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ হতে  যখন  রাজতন্ত্র বিলুপ্তপ্রায়  ঠিক তখন উল্টো চিত্র বৃটেনে। দেড় হাজার বছর যাবত বৃটেনে রাজতন্ত্র মাথা উঁচু করে  দাঁড়িয়ে আছে। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় রাজা বা রানী বংশানুক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।  যদিও রাজতন্ত্রের শুরুর দিকে রাজা রানী রাজ্য পরিচালনার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার,স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ,ব্যক্তিগত অভিরুচির অনুসরণ করতড়। কিন্তু কালক্রমে সময়ের পরিবর্তনের  সাথে সাথে তারা সময়োপযোগী জনগণের চাহিদার আলোকে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করার ফলে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী হয়।

ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ

ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার পিছনে  বহুবিদ কারন রয়েছে । এর পিছনে কতিপয় কারণ বিদ্যমান রয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এ বিষয়ে  বহুবিধ কারণ উল্লেখ করেছেন। নিম্নে তা উপস্থাপন করা হলোঃ

১। রক্ষণশীলতাঃ  ইংরেজ জাতি অধিক মাত্রায় রক্ষণশীল। তাদের রক্ষণশীল  আচরণের জন্য  ব্রিটেনে  রাজতন্ত্র টিকে আছে। সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি ইংরেজ জাতির আন্তরিক সমর্থন  বহু দিনের পুরনো। দীর্ঘ  আর এই শ্রদ্ধাবোধই বিকেলে রাজতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ।

২। গণতন্ত্রীকরণঃ ব্রিটেনের রাজতন্ত্র   বর্তমানে  নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত রয়েছে। শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রীকরণের কারণে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র  গণতন্ত্রের পথে কোন বাধা সৃষ্টি করে না। গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার কারণে ব্রিটেনে  রাজতন্ত্র প্রবাহমান রয়েছে ।  

আরো পড়ুনঃ ডুরখেইমের জৈবিক সংহতি 

৩। রাজপদের ব্যবহারিক মূল্যঃ রাজপদের ব্যবহারিক মূল্যে   ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ। ব্রিটেনে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা হিসেবে রাজশক্তি ব্যবহার হয়ে থাকে । রাজাবা রানী যেকোনো নীতি নির্ধারণে মন্ত্রিসভাকে পরামর্শ দেন।  নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসেন আবার চলে যান।  মন্ত্রিসভার উত্থান-পতন হয়। কিন্তু রাজা বা রানী সারাজীবন পদে আসীন থাকেন।  

৪। সংসদীয় ব্যবস্থার সমর্থকঃ  সংসদীয় ব্যবস্থার সমর্থন করা  ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার আরেকটি অন্যতম কারণ ।  ব্রিটেনে সংসদীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজা বা রানীর  মন্ত্রিসভাকে সর্বত্রই সহায়তা করেন। 

৫। রাজা রানীর হস্তক্ষেপ মুক্তঃ  ব্রিটেনে তত্ত্বগতভাবে সকল ক্ষমতা রাজার নামে পরিচালিত হলেও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের  সদস্যগণ স্বাধীনভাবে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। রাজা বা রানী এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় কোন সমস্যা সৃষ্টি করছে নাযার কারণে এখনো রাজতন্ত্র টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়।

৬। ধারাবাহিকতাঃ প্রশাসনিক ধারাবাহিকতার অন্যতম নিদর্শন হল ব্রিটেন। রাজা বা রানী এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ব্রিটেনের মন্ত্রিসভার পতন ও গঠনে রাজা রানীর গুরুত্ব অপরিসীম। এ সময় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রাজা বা রানী প্রশাসনের হাল ধরেন এবং ধারাবাহিক ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। 

৭। ব্যয়বহুল নয়ঃ ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ব্যয়বহুল নয়। বাৎসরিক বাজেটের মাত্র  শতকরা একভাগ  এর পেছনে ব্যয় হয়।  উপযোগিতার তুলনায় এ ব্যয় অনেক কম। রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনে নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে হলে ব্যয়ের পরিমাণ বেশী হত।

৮। ঐক্যের প্রতীকঃ  ব্রিটেনের রাজা বা রানী ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিমান হয়। তিনি ঐক্যের ধারক  বাহক ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল। রাজা বা রানী দেশবাসীর অনুকূলে কথা বলেন এবং জনগণের মধ্যে ঐক্যর বন্ধন সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। 

৯। মনস্তাত্তিক কারণঃ মনস্তাত্তিক কারণে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে আছে বলে অনেকে  ধারণা করেন।    ব্রিটেনের রাজা বা রানী জনগণের কাছে পিতা-মাতার ন্যায় সম্মানিত হয়। তিনি সর্বদা বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে আন্তরিকভাবে আলাপ আলোচনা করেন। প্রয়োজনে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি চিত্র

১০। নিরপেক্ষতাঃ নিরপেক্ষতা ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের পিছনে ইন্ধন যোগায়। রাজা বা রানী ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ ব্যক্তি। তিনি নিরপেক্ষভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। রাজা বা রানী দলাদলির উর্ধ্বে থাকেন। তাঁর এ নিরপেক্ষতা রাজতন্ত্রকে বহাল রেখেছে।

১১। সংযোগ সৃষ্টিঃ  ব্রিটেনের  রাজা বা রানী  কমনওয়েলথের প্রধান। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র কমনওয়েলথের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে থাকে। ডোমিনিয়ন স্টেটগুলোর মধ্যে তিনি যোগসূত্র স্বরূপ।  

১২। আনুষ্ঠানিকতাঃ  আনুষ্ঠানিকতা ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রাজা বা রানী আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করেন। এখানে যাবতীয় কাজকর্ম রাজা বা রানীর নামে সম্পাদিত। বিচারকার্যও তাঁর নামে সম্পাদিত হয়। তার নামে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জনগণ ব্যক্তি হিসেবে রাজায় প্রতি অনুরক্ত। রাজা বা রানী আনুষ্ঠানিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করেন।

১৩। ব্যক্তিগত প্রভাবঃ রাজা বা রানীর ব্যক্তিগত প্রভাবে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে আছে । ব্যক্তিগতভাবে তিনি অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে ব্রিটেনের রাজশক্তির অস্তিত্বের  টিকিয়ে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল মহারানী ভিক্টোরিয়া। তিনি জনগণের কাছে ছিলেন জননী সাদৃশ্য। সুতরাং রাজা  বা রানীর ব্যক্তিগত প্রভাব বৃটেন রাজতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ।

১৪। জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের উৎসঃ  ব্রিটেনের রাজা বা রানী জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের উৎস। তাকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। এক ঘেয়েমী  দূর করতে  ব্রিটেনে সাধারণ মানুষকে রাজা বা রানী জাঁকজমকের সাথে জাগিয়ে তোলেন। সরকারী কার্যধারার মধ্যে তিনি বৈচিত্র সৃষ্টি করেন।  এরূপ জাঁকজমক ও বৈচিত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উদ্যম সৃষ্টি করে এবং রাজতন্ত্র  টিকে থাকতে সহায়তা করে।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস  বিফ সাজেশন

১৫।চিরন্তন প্রতিনিধিঃ ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার পিছনে রাজা বা রানী অদন্ত প্রহরীর ন্যায় কাজ করে। রাজা বা রানী শাসন ব্যবস্থায় চিরন্তন প্রতিনিধি। নিরপেক্ষতার কারণে রাষ্ট্রের যাবতীয় সরকারী কার্যাদি  রাজা বা রানীর নামে পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় মহিমা ও গৌরব সমুন্নত রাখেন।

উপসংহারঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি ,রাজতন্ত্র ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বহুবিধ কারেণে ব্রিটেনে  রাজতন্ত্র টিকে থাকলেও মূলত  অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারনে রাজতন্ত্র নিরবিচ্ছিন্নভাবে আজও টিকে আছে।  

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252