মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বুঝ?

মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বুঝ? এর বৈশিষ্ট সমূহ লেখো।

ভূমিকা: মৌলিক গণতন্ত্র একটি বিশেষ ধরণের শাসন ব্যবস্থা যা পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক প্রবর্তিত হয়। এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোকে সরলীকৃতভাবে প্রয়োগ করলেও জনগণের অংশগ্রহণকে সীমাবদ্ধ করে। ১৯৫৯ সালে চালু করা এই শাসনব্যবস্থার মূল ধারণা ছিল, জনগণ সরাসরি নির্বাচন না করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের নেতৃবৃন্দকে নির্বাচিত করবে।

মৌলিক গণতন্ত্রের পরিচয়: ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পর জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন। ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারিখে তিনি এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোকে পরিবর্তন করার লক্ষ্যে তিনি জনগণের কাছে গণতন্ত্রকে আরও সরলভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তবে এটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সঠিক চর্চা ছিল না, বরং একটি সীমিত এবং প্রায় সামরিক শাসনের আদলে একটি ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।

মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ: মৌলিক গণতন্ত্রের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এই ব্যবস্থার স্বকীয়তা তুলে ধরে। নিচে মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো:

আরো পড়ুনঃ ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য

১. সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত: মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ছিলেন সার্বভৌম শাসক। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী, আইনপ্রণেতা এবং বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে ক্ষমতা ভোগ করতেন।

২. পরোক্ষ নির্বাচন: মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে পারত না। তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করত, যারা পরবর্তীতে সরকার ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করত। জনগণের সরাসরি ভোটদানের সুযোগ ছিল না, ফলে এই শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা থেকে দূরে ছিল।

৩. গণতন্ত্রের নামে সামরিক শাসন: যদিও এই শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রের নামে পরিচিত ছিল, তবে বাস্তবে এটি সামরিক শাসনেরই একটি রূপ। কারণ জনগণের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত ছিল এবং সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল।

৪. রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞা: মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। জনগণ কোনো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে পারত না, ফলে সরকার প্রায় নিষ্ক্রিয়ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকত।

৫. বিচ্ছিন্ন জনগণের ভূমিকা: এই শাসন ব্যবস্থায় জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরিবর্তে, তাদের ভূমিকা আরও সীমিত হয়ে যায়। রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকায় তারা কার্যত শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

মৌলিক গণতন্ত্রের স্তরসমূহ:

মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল চার স্তরে বিভক্ত, যার মধ্যে রয়েছে:

১. ইউনিয়ন কাউন্সিল: মৌলিক গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন স্তর ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিল। এটি ৫-৮ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো এবং প্রত্যেক কাউন্সিলে প্রায় ১৫ জন সদস্য থাকত, যার মধ্যে ১০ জন সরাসরি নির্বাচিত এবং বাকি ৫ জন মনোনীত হতেন।

২. থানা কাউন্সিল: মৌলিক গণতন্ত্রের দ্বিতীয় স্তর ছিল থানা কাউন্সিল। এই পরিষদে নির্বাচন হতো না, বরং থানার সরকারি কর্মকর্তারা এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানরা এর সদস্য হতেন। এটি থানার মধ্যে বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের কার্যক্রমের সমন্বয় করত।

৩. জেলা কাউন্সিল: থানা কাউন্সিলের উপরে ছিল জেলা কাউন্সিল। এতে নির্বাচিত এবং মনোনীত সদস্য উভয়েই থাকত। এটি জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করত এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকত।

৪. বিভাগীয় কাউন্সিল: মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর ছিল বিভাগীয় কাউন্সিল। এটি জেলা কাউন্সিলগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করত এবং একটি বৃহত্তর প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে কাজ করত।

আরো পড়ুনঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বিগত সালের বিফ 

মৌলিক গণতন্ত্রের সমালোচনা:

মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা সমালোচনার শিকার হয়েছিল। বিশেষত:

১. গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার অভাব: এই ব্যবস্থায় জনগণের সরাসরি ভোটদানের সুযোগ না থাকায় এটি গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা ছিল না।

২. রাষ্ট্রপতির অতিরিক্ত ক্ষমতা: এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী ছিল।

৩. জনগণের বিচ্ছিন্নতা: মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা জনগণকে শাসন কাঠামো থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, যার ফলে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়নি।

উপসংহার: মৌলিক গণতন্ত্র একটি সীমিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল, যা মূলত সামরিক শাসনের আড়ালে পরিচালিত হত। এর মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরিবর্তে, তাদের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়েছিল। এই ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি এবং ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতাচ্যুতি ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এর অবসান ঘটে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252