যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বর্ণনা কর।
ভূমিকা: নয় মাস নির্মম সশস্ত্র সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বাঙালি জাতিকে ব্যাপক ধ্বংস ও হতাশার মধ্যে ফেলেছিল। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের মিয়াওয়ালি কারাগার থেকে মুক্তি পান। তারপর তিনি ১০- এ জানুয়ারি লন্ডন ও দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তার প্রত্যাবর্তনের পর, তিনি রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটিকে পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জিং কাজ শুরু করেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের উদ্যোগ: মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি জাতি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করে। যোগাযোগ, অর্থনীতি, কৃষি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সহ দেশের প্রতিটি দিকই এর অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে মারাত্মক ভঙ্গুরতার শিকার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জাতি পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিম্নে বঙ্গবন্ধুর নেয়া পদক্ষেপ গুলো আলোচনা করা হলো:
১. পুনর্বাসন: মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী হাটবাজার থেকে শুরু করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে অসংখ্য উদ্বাস্তুকে গৃহহীন করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার আন্তর্জাতিক ত্রাণ বিতরণে চ্যালেঞ্জ এবং ভগ্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করে এবং ৪৩ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি পুনর্নির্মাণ করে। সরকার রেড ক্রস কর্মীদের পুনর্গঠন করে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের বিতরণের জন্য বিভিন্ন স্তরে দক্ষ ত্রাণ কমিটি গঠন করে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের অভভুদয়ে বাংলা ভাষার অবদান
২. সংবিধান প্রণয়ন: বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘ আলোচনার পর, গণপরিষদ ৪ নভেম্বর, ১৯৭২-এ সংবিধান চূড়ান্ত করে এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। দেশের স্বাধীনতার পর এটি একটি জটিল কাজ ছিল।
৩. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ: স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু সরকার পাট, বস্ত্র, চিনিকল, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আইন পাস করে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) আদেশের অধীনে সকল শাখাসহ ১২টি ব্যাংকের দখল নেয় এবং সেগুলোকে ৬টি নতুন ব্যাংকে একীভূত করে। রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১৬ (Po-16) এর অধীনে প্রায় ৮৫% অবাঙালি এবং পাকিস্তানি মালিকানাধীন শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং রাষ্ট্র তাদের মালিকানা ও দখল নেয়।
৪. পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন: বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে পারদর্শিতা প্রদর্শন করে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর জোর দিয়ে এবং সমস্ত জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য এই সরকার একটি জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করেছিলেন। ভারতীয় সৈন্যদের যখন বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানো হয় তখন তার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ও সমর্থন ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। উপরন্তু, তিনি সক্রিয়ভাবে মুসলিম দেশগুলির সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে কাজ করেন।
৫. কৃষি খাতে সংস্কার: বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে কৃষি খাত সংস্কার করেন। তিনি নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে কৃষকদের বাড়ি, পুনর্বাসন সহায়তা, সার, বীজ, লাঙ্গল, কীটনাশক, গবাদি পশু এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বিতরণের সুবিধা দেন। এছাড়াও, তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন এবং সমস্ত বকেয়া জমির খাজনা পরিশোধ করেন। ধান, পাট, তামাক এবং আখের মতো প্রধান কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের পাশাপাশি সুদ সহ কৃষকদের সমস্ত বকেয়া মওকুফ করা হয়।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের অভভুদয়ে বাংলা ভাষার অবদান
৬. শিক্ষা খাত সংস্কার: যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের সংবিধানে সর্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। নিরক্ষরতা দূর করার লক্ষ্যে, সরকার নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সকল ছেলে ও মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৬ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬-শে জুলাই ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। নেতৃত্ব গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু এই কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের নেতৃত্ব দেন।
৭. অর্থনৈতিক খাত সংস্কার: যুদ্ধের পুরো নয় মাস ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক খাত পুনরুদ্ধার করে সচল করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩% থেকে ৫%-এ উন্নীত করা। একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, অর্থনীতির চাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আত্মনির্ভরতার উপর জোর দেওয়া।
৮. আইন প্রণয়ন: মুজিব সরকার উদ্বোধনী বছরেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং দেশের পুনর্গঠনে অবদান রাখার জন্য বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আইন বাস্তবায়ন করে। উল্লেখযোগ্য আইনগুলির মধ্যে রয়েছে পরিত্যক্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইন এবং বাংলাদেশ দালাল আইন। এটি বিদ্যমান সমস্যাগুলির সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৯. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি: মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দেশের সমগ্র দেশের সড়ক অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। এই সংকটময় সময়ে, বঙ্গবন্ধু ৯৭টি নতুন সড়ক সেতু নির্মাণ এবং ভেঙে পড়া রেল সেতু পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেন। উপরন্তু, তিনি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
১০. বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন: মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে অসংখ্য স্থানে বিদ্যুতের সাবস্টেশন ভেঙে ফেলা হয়। বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী, সারাদেশে গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য ১৯৭৩ সালে একটি ব্যাপক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
আরো পড়ুনঃ সামরিক শাসন বলতে কি বুঝ?
১১. ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন: ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে পরিচালিত স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম নির্বাচন হিসাবে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক চিহ্নিত করে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সুসংহত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
১২. নারীদের কল্যাণে গৃহীত ব্যবস্থা: ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দুস্থ মহিলাদের পশে দাঁড়ানোর জন্য মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। এছাড়া সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা বরাদ্দের ব্যবস্থাও তিনি বাস্তবায়ন করেন।
১৩. সরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের কল্যাণার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ: তিনি সরকারি কর্মচারী ও কর্মীদের জন্য বেশ কিছু সুবিধাজনক পদক্ষেপ শুরু করেন। তিনি একটি নতুন বেতন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১০ স্তর বিশিষ্ট একটি নতুন বেতন স্কেল প্রবর্তন করেন। উপরন্তু, তিনি কর্মীদের জন্য একটি সংশোধিত বেতন কাঠামো উন্মোচন করেছেন।
১৪. ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন: বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। যার যে ধর্ম সে তা পালন করবে। এদেশের কোনো ধর্ম নেই তবে মানুষের ধর্ম আছে। অর্থাৎ তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কাজ করেছেন।
১৫. বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য: বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য রাজনৈতিক হলেও বঙ্গবন্ধু দেশের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় এবং সবাই হাতে হাত রেখে দেশকে উন্নত করার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছেন। এটি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে অনেক সহায়তা করে।
১৬. নিজ উদ্যোগে মনিটরিং:বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে বিভিন্ন রকম উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং সেই কাজগুলো নিজ থেকে মনিটরিং করার চেষ্টা করেছেন। এটি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উপসংহার: বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি আনন্দময় সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও দেশের উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে তার সময়োপযোগী উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়।