জন লকের সম্পত্তি তত্ত্ব

জন লকের সম্পত্তি তত্ত্ব

ভূমিকা: জন লক (১৬৩২-১৭০৪) ছিলেন ইংরেজ দার্শনিক, যিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারণার বিকাশে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তার “Two Treatises of Government” (১৬৯০) গ্রন্থে তিনি সম্পত্তির অধিকার এবং শ্রমের মাধ্যমে সম্পত্তির সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। লকের মতে, সম্পত্তি মানুষের মৌলিক অধিকার, যা প্রাকৃতিক অবস্থায়ও বিদ্যমান ছিল এবং এর ওপর কারও হস্তক্ষেপের অধিকার নেই।

সম্পত্তি সম্পর্কে লকের ধারণা:

লক সম্পত্তি তত্ত্বকে ব্যক্তির প্রাকৃতিক অধিকার হিসেবে দেখেছেন। তিনি মনে করেন, সম্পত্তি শুধু বৈষয়িক সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানুষের জীবন, স্বাধীনতা এবং উৎপাদিত সম্পদকেও অন্তর্ভুক্ত করে। তার মতে, মানুষ স্বভাবতই স্বাধীন, সমান এবং তাদের শ্রমের মাধ্যমে সম্পত্তি অর্জনের অধিকার রয়েছে। এই অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সুরক্ষিত হওয়া উচিত।

সম্পত্তির যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা:

লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে (State of Nature) মানুষ তার পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করে এবং তা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে স্বাধীনতা এবং মর্যাদা দেয়। মানুষ প্রকৃতির দেয়া উপকরণ এবং নিজের শ্রম মিশ্রণ করে সম্পত্তি তৈরি করে। লক বলেন, মানুষ তার দেহ এবং শ্রমের অধিকারী। যখন সে তার শ্রম কোনো বস্তুর সাথে মিশ্রিত করে, তখন সেই বস্তু তার সম্পত্তিতে পরিণত হয়।

আরো পড়ুনঃ রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ আলোচনা

ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার:

লক ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তার মতে, ব্যক্তি তার শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তির একক মালিক। তিনি মনে করেন, ব্যক্তি তার শ্রমের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বা সম্পদ সৃষ্টি করে এবং তার উৎপাদিত সম্পত্তি তার ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে গণ্য হয়। লকের দৃষ্টিতে, এই অধিকার চিরস্থায়ী এবং কেউ তা নষ্ট বা হরণ করতে পারে না।

সম্পত্তির সীমাবদ্ধতা:

লকের মতে, সম্পত্তি সীমাহীনভাবে অর্জন করা উচিত নয়। তিনি বলেন, মানুষ তার জীবিকার জন্য যতটুকু সম্পদ প্রয়োজন, ততটুকু সম্পত্তি ন্যায্যভাবে অর্জন করতে পারে। তবে সম্পদের অপচয় করা বা অন্যদের বঞ্চিত করা অনুচিত। লক মনে করেন, সম্পত্তি একধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা, যেখানে অতিরিক্ত সম্পদ সমাজের অন্যান্য সদস্যদের কাজে লাগতে পারে।

শ্রমের ভূমিকা ও মূল্যতত্ত্ব:

জন লকের সম্পত্তি তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো শ্রম। তিনি বিশ্বাস করেন, শ্রমের মাধ্যমেই সম্পত্তি তৈরি হয়। প্রকৃতির উপাদান যখন শ্রমের সাথে মিশ্রিত হয়, তখনই তা মূল্যবান সম্পত্তিতে পরিণত হয়। লকের মতে, ব্যক্তির উৎপাদিত পণ্য বা সম্পত্তির মূল্য নির্ধারিত হয় তার শ্রমের মাধ্যমে। এজন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের মর্যাদা ও আত্মসম্মান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

সম্পত্তি তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য:

জন লকের সম্পত্তি তত্ত্বে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যা তার দর্শনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এসব বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

১. প্রাকৃতিক অধিকার: সম্পত্তি মানুষের জন্মগত অধিকার এবং এটি কোনো রাষ্ট্র বা শাসকের দ্বারা হরণ করা উচিত নয়।

২. শ্রম মিশ্রিত সম্পত্তি: মানুষ যখন তার শ্রম কোনো প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে মিশ্রিত করে, তখন তা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়।

৩. অপচয় ও সীমাবদ্ধতা: মানুষ যতটুকু সম্পত্তি ন্যায্যভাবে প্রয়োজন, ততটুকুই অর্জন করতে পারে। অতিরিক্ত সম্পত্তি অর্জন বা অপচয় করা উচিত নয়।

আরো পড়ুনঃ সার্বভৌমত্ব ও সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণা

৪. সামাজিক দায়বদ্ধতা: ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সম্পত্তি সমাজের অন্য সদস্যদের কাজে লাগাতে হবে।

৫. সম্পত্তির মর্যাদা: ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি করে এবং তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে।

৬. চুক্তির প্রয়োজন ছাড়াই সম্পত্তির অধিকার: সম্পত্তি অর্জনের জন্য কোনো বিশেষ চুক্তির প্রয়োজন নেই, এটি মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার।

উপসংহার: লকের মতে, সম্পত্তি শুধু অর্থনৈতিক অধিকার নয়, বরং এটি ব্যক্তির স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। তার সম্পত্তি তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, ব্যক্তি তার শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত সম্পদকে নিজের সম্পত্তি হিসেবে অর্জন করতে পারে এবং এটি কোনো রাষ্ট্র বা শাসক দ্বারা হরণ করা উচিত নয়। লকের এই তত্ত্ব আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তায় এবং ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252