বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পরিবারের পরিবর্তনশীল ভূমিকা

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পরিবারের পরিবর্তনশীল ভূমিকা পর্যালোচনা কর। 

ভূমিকা: পরিবার হলো কিছু ব্যক্তির সমষ্টিকে যারা একত্রে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। পরিবার গ্রামীণ সমাজের মূল ভিত্তি। কারণ পরিবারকে ঘিরেই গ্রামীণ সমাজের সকল বিষয় আবর্তিত হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে একটি স্থিতিশীল এবং সংহত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু কৃষি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও আধুনিক এক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে পরিবার প্রথায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পরিবারের ভূমিকা ও কাঠামো ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে।

পরিবর্তনের কারণসমূহ

অর্থনৈতিক: মানুষের কৃষির উপর নির্ভরতা কমে যাওয়া এবং শিল্পায়নের প্রসার বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবার গুলোর অভ্যন্তরে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তাছাড়া নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং অভিবাসন বৃদ্ধির ফলেও পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসতেছে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ

সামাজিক: পরিবারের সামগ্রিক পরিবর্তনের পেছনে কিছু সামাজিক পরিবর্তনও দ্বায়ী। যেমন: শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়া, প্রযুক্তির প্রভাব, এবং পারিবারিক মূল্যবোধের পরিবর্তন।

রাজনৈতিক: বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণেও পরিবারে পরিবর্তন ঘটে থাকে।আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রসার, মানবাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের উপর জোর প্রদান এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতেছে।

বাংলাদেশে পরিবারের পরিবর্তনশীল ধারা

কাঠামোগত পরিবর্তন: শিল্পায়ন ও নগরায়ন অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে মানুষ কর্মের সন্ধানে শহরে ধাবিত হচ্ছে। অনেকে আবার দেশের বাইরে চাকরি ও ব্যবসায় করতে গিয়ে একক পরিবারে বসবাস করছে। যার ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে অণু পরিবার গড়ে উঠছে। এজন্যই পরিবারের আকার এবং  কাঠামোয় এসেছে আমূল পরিবর্তন।

অর্থনৈতিক কাজের পরিবর্তন: গ্রামীণ সংস্কৃতিতে পরিবারগুলো বেশিরভাগ কৃষি নির্ভর। এছাড়াও এখানে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার যেমন: কামার কুমোর, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি লোকজন বাস করে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের প্রভাবে মানুষ তাদের পেশা পরিবর্তন করে ফেলতেছে। অনেকেই আয়ের উৎস হিসেবে অনলাইন প্লাটফর্ম গুলোকে বেছে নিচ্ছে। আবার অনেকেই অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে গ্রামীণ সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে।

আরো পড়ুনঃ  বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বলতে কি বুঝ?

রাজনৈতিক পরিবর্তন: গ্রামীণ পরিবারগুলোতে রাজনৈতিক নেতিবাচক পরিবর্তন বর্তমানে সুস্পষ্ট। অতীতে পরিবারগুলো বিচারকার্য বা অন্যান্য পরামর্শের জন্য গ্রামীণ মোড়লদের আশ্রয় নিতো। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার প্রসারে মানুষের মাঝে সচেতনতা এবং জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে পাশাপাশি নারী শিক্ষারও উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেছে। এখন মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হচ্ছে এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতেছে। যার ফলে তাদের মাঝে ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং বিভিন্ন কোন্দলে নিজেদেরকে বিভক্ত করে ফেলছে। “Village Politics ” প্রত্যয়টি এখন বিশদ ভাবে দৃশ্যমান।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: গ্রামীণ সংস্কৃতি ও চিত্তবিনোদন  ব্যবস্থা নগর সংস্কৃতির তুলনায় অধিকতর ঐতিহ্যবাহী, যাতে আবহমান গ্রাম জীবনের স্বরূপ ফুটে উঠে। গ্রামীণ সমাজে হচ্ছে শ্রেণি বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম। তাই এখানকার বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, খেলাধুলা ও যাত্রাভিনয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অভিন্ন চিত্র দেখা যায়। আধুনিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে নগর সংস্কৃতির প্রভাব গিয়ে পড়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির উপর। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি সর্বদাই পরিবর্তন হচ্ছে।

ধর্মীয় পরিবর্তন: গ্রামীণ পরিবারগুলোতে প্রায় সকল সদস্যই একই ধর্মীয় বিশ্বাসে নিজেদেরকে আবদ্ধ রাখে। এখানে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর। কিন্তু আধুনিক শিক্ষার প্রসারে মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। আর এই শিক্ষিত মানুষেরা প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার ও গৌরামিকে নাকচ করে দিয়ে সঠিক ধর্মীয় পন্থায় নিজেদেরকে পরিচালিত করতেছে। এর ফলে একই পরিবারের একাধিক মতাদর্শের সদস্য সৃষ্টি হয়ে পরিবারের মাঝে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।

সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন: সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। একটি শিশু তার আশেপাশের পরিবেশ এবং আত্মীয়-স্বজনদের নিকট থেকে জীবন পরিচালন পদ্ধতি শিখে বড় হয় আর এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় সামাজিকীকরণ। গ্রামীণ পরিবারগুলোতে সকল সদস্যরা যৌথভাবে বসবাস করে। তাই শিশুদেরকে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি প্রতিবেশীরাও লালন পালনে সহযোগিতা করে থাকে। অপরদিকে শহরে অণু পরিবারগুলোতে এই ধরনের সহযোগিতা ও সহমর্মিতার নিদর্শন লক্ষ্য করা যায় না। যার ফলে পারিবারিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে থাকে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পণ্য উৎপাদন অধিক হরে বৃদ্ধি পেয়েছে যা সমাজ জীবনের উপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। মানুষ এখন তাদের পেশা পরিবর্তন করে ফেলতেছে এবং তাদের আচার-আচরণেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন মানুষের চিন্তা-চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ সবকিছুতেই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে যা। মোটের উপর, বলা যায় বিশ্বায়নের প্রভাবে গ্রামীণ সমাজের অন্যতম ভিত্তি পরিবারের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252