১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের পটভূমি

১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের পটভূমি

ভূমিকা: ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন ব্রিটেনের দরিদ্র আইন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে দেশের দরিদ্র এবং বেকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়। ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনটি ত্রুটিপূর্ণ এবং অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, যার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য নতুন এবং কার্যকর একটি আইন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন দরিদ্রদের জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করে এবং দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাঠামো প্রবর্তন করে।

১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের পটভূমি

শিল্প বিপ্লব এবং দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি: শিল্প বিপ্লবের কারণে গ্রাম থেকে শহরে মানুষদের ব্যাপক অভিবাসন ঘটে। শহরগুলোর দ্রুত বর্ধিত জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হয়, যা সরকারের জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও, কৃষি সংস্কার এবং জমি হারানোর কারণে অনেক কৃষক দরিদ্র হয়ে পড়ে। ফলে দরিদ্রদের সহায়তার জন্য পূর্ববর্তী আইনের পরিবর্তন জরুরি হয়ে ওঠে।

আরো পড়ুনঃ গ্রামীণ সমাজসেবা কি

দরিদ্র আইন কমিশন (১৮৩২): ১৮৩২ সালে, ব্রিটিশ সরকার দরিদ্র আইন কমিশন গঠন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্রদের সহায়তার জন্য নতুন এবং কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। কমিশন সুপারিশ করে যে দরিদ্রদের জন্য কেন্দ্রের পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে দায়িত্ব পালনের একটি কাঠামো তৈরি করা হোক।

ব্যয় সংকট: ১৬০১ সালের দরিদ্র আইন দরিদ্রদের জন্য পুনর্বাসন এবং ত্রাণ সহায়তা প্রদান করলেও, ক্রমবর্ধমান দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সাহায্যের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ব্যবস্থা আর কার্যকর ছিল না। স্থানীয়ভাবে দরিদ্রদের সহায়তা করার জন্য করের বোঝা বাড়তে থাকে এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ এই বোঝা নিয়ে অসন্তুষ্ট হতে থাকে।

১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ

১. কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে দায়িত্ব বিভাজন: দরিদ্রদের সহায়তার দায়িত্ব কেন্দ্রের পরিবর্তে স্থানীয় সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রতিটি কাউন্টিতে একটি স্থানীয় দরিদ্র আইন ইউনিয়ন বা পৌরসভা গঠন করা হয়, যারা দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল।

২. দরিদ্রদের শ্রেণিবিন্যাস: আইনের অধীনে দরিদ্রদের তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়:

  • অস্থায়ী অভাবগ্রস্ত: যারা কাজ না পেয়ে দরিদ্র অবস্থায় পড়েছে।
  • স্থায়ী অভাবগ্রস্ত: যারা শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতার কারণে কাজ করতে অক্ষম।
  • অলস অভাবগ্রস্ত: যারা কাজ করার ইচ্ছা বা সক্ষমতা রাখে না এবং অলস জীবনযাপন করে।

৩. ওয়ার্কহাউস ব্যবস্থা: এই আইনের অধীনে, দরিদ্রদের জন্য ওয়ার্কহাউস (workhouse) স্থাপন করা হয়। ওয়ার্কহাউসে দরিদ্রদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এখানে বসবাসের শর্তগুলো খুব কঠোর ছিল, যাতে দরিদ্ররা সরকারের সহায়তার উপর নির্ভর না করে। ওয়ার্কহাউসের শর্তগুলি দরিদ্রদের জন্য অত্যন্ত কঠিন এবং অসহনীয় ছিল, যাতে দরিদ্ররা এটি বেছে না নেয়।

আরো পড়ুনঃ ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইনের গুরুত্ব

৪. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ: আইনের অধীনে দরিদ্রদের উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। দরিদ্রদেরকে কঠোর শর্তে সাহায্য প্রদান করা হতো, যাতে তারা নিজেদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়।

৫. দারিদ্র্য সহায়তার নতুন কাঠামো: প্রথমবারের মতো দরিদ্রদের সহায়তার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়। স্থানীয় সরকারগুলিকে দরিদ্রদের সহায়তার দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং দরিদ্র সহায়তার ব্যয় বহনের জন্য স্থানীয় করের ব্যবস্থা করা হয়।

৬. ব্যক্তিগত দায়িত্বের ধারণা: আইন অনুসারে, দরিদ্ররা তাদের নিজেদের দারিদ্র্যের জন্য দায়ী। তারা সাহায্য প্রাপ্তির যোগ্য হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য ছিল। সরকার দরিদ্রদের সাহায্যের পাশাপাশি তাদের দায়িত্বের ধারণা তৈরি করতে চেষ্টা করে।

৭. নগদ সাহায্যের নিষেধাজ্ঞা: এই আইনে দরিদ্রদের নগদ সাহায্য প্রদান প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। নগদ সাহায্যের পরিবর্তে দরিদ্রদের শারীরিক কাজের মাধ্যমে সাহায্য করা হতো।

৮. উপবৃত্তি ব্যবস্থা: যারা ওয়ার্কহাউসে কাজ করতে অক্ষম ছিল, তাদের জন্য উপবৃত্তি প্রদান করা হতো। তবে, উপবৃত্তি অত্যন্ত নগণ্য ছিল, যা দরিদ্রদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না।

৯. সামাজিক মর্যাদা হ্রাস: এই আইনের মাধ্যমে দরিদ্রদের সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পায়। দরিদ্রদেরকে একটি নীচু শ্রেণি হিসেবে দেখা হয় এবং তাদেরকে সমাজে অবাঞ্ছিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১০. শ্রমের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ: ওয়ার্কহাউসের কঠোর ব্যবস্থা দরিদ্রদেরকে কঠোর পরিশ্রম করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে তৈরি করা হয়েছিল। সমাজে অলসতা এবং অকর্মণ্যতা কমানোর জন্য এই আইন প্রণীত হয়।

আরো পড়ুনঃ সমষ্টি উন্নয়ন পদ্ধতি কি?

উপসংহার: ১৮৩৪ সালের দরিদ্র সংস্কার আইন দরিদ্র আইন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আইনের মাধ্যমে দরিদ্রদের সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য নতুন কাঠামো এবং পদ্ধতি চালু হয়, তবে এর কঠোর শর্ত এবং কঠিন ব্যবস্থার কারণে আইনটি ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। এটি দরিদ্রদের জন্য সাহায্য প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে সীমাবদ্ধ করে এবং দরিদ্রদের উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252