গণতান্ত্রিক দেশের উন্নয়নে সুশীল সমাজের ভূমিকা

সুশীল সমাজ বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নে সুশীল সমাজের ভূমিকা আলোচনা কর। 

অথবা, একটি গণতান্ত্রিক দেশের উন্নয়নে সুশীল সমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।

ভুমিকা: একটি গণতান্ত্রিক দেশে সুশীল সমাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার জন্য সুশীল সমাজ বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সুশীল সমাজ বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কারণ সুশীল সমাজ সবসময় সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বজায় রাখে। কারণ সরকার সবসময় জনগণের জন্য কাজ করে ও জনগণ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করে।

সুশীল সমাজ: সুশীল সমাজের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Civil Society. সুশীল সমাজ হলো এমন এক ধরনের গোষ্ঠী, যারা সবসময় জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করে। সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ স্বতন্ত্র কোন রাজনীতি করে না। কারণ এরা কোন দলের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থাকে না, হোক সরকারি বা বিরোধী কোন দল। সুতরাং সুশীল সমাজ হলো এমন এক ধরনের গোষ্ঠী যারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংযুক্ত না থেকে সবসময় জনগণের কল্যাণে কাজ করে।

আরো পড়ুনঃ পল্লী উন্নয়ন বলতে কি বুঝ?

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সুশীল সমাজের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কয়েকটি জনপ্রিয় জনপ্রিয় সংজ্ঞা প্রদান করা হলো

সমাজবিজ্ঞানী  Larry Diamond এর মতে, সুশীল সমাজ হলো এমন এক ধরনের গোষ্ঠী যারা একটি মধ্যবর্তী অস্তিত্বের সাথে ব্যক্তিগত ক্ষেত্র ও রাষ্ট্রের মাঝে অবস্থান করে।

কার্ল মার্কসের মতে, “সুশীল সমাজ বলতে বুঝায় এমন এক ধরনের বস্তুবাদের ভিত্তিভূমি যা আধুনিক সম্পত্তি সম্পর্কে ব্যক্তিদের সংগ্রাম এবং চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‌্যবাদের ক্ষেত্র বিশেষ।”

বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেন, “সুশীল সমাজ হলো এমন এক ধরনের গোষ্ঠী যার ধারণা এসেছে আঠার শতকে পশ্চিম ইউরোপের পুজিবাদী বুদ্ধিজীবিদের মধ্য থেকে যারা সর্বদা জনকল্যাণের জন্য কাজ করে।”

ইউএনডিপি এর মতে, সুশীল সমাজ হলো এমন এক ধরনের ক্ষেত্র যেখানে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন জম্ম নিবে ও বিকশিত হবে।”

Farnest Glenes এর মতে, “সুশীল সমাজ হচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম।

গণতান্ত্রিক দেশের উন্নয়নে সুশীল সমাজের ভূমিকা: নিম্নে একটি গণতান্ত্রিক দেশের উন্নয়নে সুশীল সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. সরকারকে পরামর্শ প্রদান: বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, বাস্তবায়নের সকল ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ সরকারকে পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। সুশীল সমাজ দেশের সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত বলে তারা দেশের সমস্যা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে যথার্থভাবে অবগত থাকে। তাই সরকার তাদের উপর বেশি নির্ভরশীল ও বিশ্বস্ত থাকে।

২. বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ প্রদান: আমাদের দেশের মত বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে নিয়োজিত রয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুশীল সমাজের সদস্যরা এসব প্রতিষ্ঠান গঠন ও এদের বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে দেশের যথার্থ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

৩. বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান: সুশীল সমাজের সদস্যরা সমাজে প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তারা সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি ও বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকে। তাই এসব সমস্যা সমাধানে তারা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করা ও স্থানীয় উদ্যোগ গ্রহণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা দেশের যথার্থ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো দুটো সেক্টর সম্পর্কে লিখ

৪. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন: আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজ দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। রাজনৈতিক দল, সরকার ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে পরামর্শের জন্য সুশীল সমাজের উপর নির্ভরশীল। তাই এক্ষেত্রে সকলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা সুশীল সমাজের পক্ষে অনেকটা সহজ হয়।

৫. সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা: সুশীল সমাজের সদস্যরা সমাজে ব্যাপকভাবে প্রভাবশালী হয়। লোকজন তাদেরকে অনুসরণ করে। তাই বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও জনস্বার্থ রক্ষায় আইন প্রণয়ন ও তার যথার্থ বাস্তবায়নের জন্য তারা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয় যা

দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা: বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক অন্যায়, অবিচার ও শোষণ চালানো হয় ব্যাপক হারে, যা দেশের যথার্থ আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিরোধী। তাই এগুলো প্রতিরোধের জন্য সুশীল সমাজ নাগরিকদেরকে সচেতন করে তাদেরকে সাথে নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তুলে দেশের যথার্থ উন্নয়ন নিশ্চিত করে।

৭. সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা পালন: সুশীল সমাজের সদস্যরা বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যা সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক থাকে। তারা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক সংস্কার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। আমাদের দেশে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

৮. স্বেচ্ছাসেবী নাগরিক সংগঠন গঠন: সরকারের একার পক্ষে নাগরিকদের সার্বিক সমস্যা ও চাহিদা মোকাবিলা করতে পারে না, তথা সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না। এক্ষেত্রে জনগণের মধ্য থেকে আঞ্চলিক ও স্থানীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এসব উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সুশীল সমাজের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গঠনে কার্যকর ভূমিকা

পালন করে। এসব সংগঠন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

৯. সামাজিক মূলধন গঠন: কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে জনগণ একত্রে কাজ করার সময় তাদের মধ্যে এক বিশেষ শক্তি সৃষ্টি হয় এটাকে সামাজিক মূলধন বলে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এটা আর্থিক মূলধনের বিকল্প হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। আর এ সামাজিক মূলধন গঠনে সুশীল সমাজের সদস্যরা প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।

১০. জনগণের শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন: আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুশীল সমাজকে অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা দেশের বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখে। তাদের এ ভূমিকা দেশের যথার্থ স্থিতিশীল আর্থসামাজিক উন্নয়ন আনয়নে সহায়তা করে।

১১. মিডিয়ার ব্যবহার: সুশীল সমাজের সদস্যরা সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়। তারা তাদের এ প্রভাব কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পরিচিতি বিগত সালের কোশ্চেন 

১২. র‍্যালি ও শোভাযাত্রার আয়োজন: সুশীল সমাজের সদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা আনয়নে র‍্যালি, শোভাযাত্রা প্রভৃতির আয়োজন করতে পারে, যা দেশের সামাজিক বুনিয়াদকে শক্তিশালী করে যথার্থ সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা হতে দেখা যায় যে, গণতান্ত্রিক উদারনৈতিকতা, সুশাসন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা হলো সুশীল সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে, সুশীল সমাজের ভূমিকা ছাড়া দেশের আর্থসামাজিকে যথার্থ উন্নয়ন আনয়ন করা সম্ভব নয়। তাই কল্যাণকামী প্রতিটি রাষ্ট্রে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন ।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252