ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলো কী কী?

ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলো কী কী?

ভূমিকা: ব্রিটিশ সংবিধান পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম সংবিধান। যদিও এটি মূলত অলিখিত, তবে বিভিন্ন প্রথা, রীতি, এবং কিছু লিখিত আইন এর ভিত্তি গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন সময়ে গৃহীত আইন, বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক রীতিনীতির মাধ্যমে এই সংবিধানের কাঠামো গঠিত হয়েছে। সংবিধানের নির্দিষ্ট কোনো দলিল না থাকলেও, এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন প্রকারের উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এই আলোচনায় আমরা ব্রিটিশ সংবিধানের বিভিন্ন উৎস ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করব।

ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসসমূহ:

ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলোকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: লিখিত উৎস এবং অলিখিত উৎস।

আরো পড়ুনঃ সাম্প্রদায়িকতা কি? ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ

লিখিত উৎস:

ব্রিটিশ সংবিধানের কিছু অংশ লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, যা ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম ও নীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে।

১. ম্যাগনা কার্টা (১২১৫): ম্যাগনা কার্টা হল ১২১৫ সালে রাজা দ্বিতীয় জনের সময় স্বাক্ষরিত একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি রাজা ও তার প্রজাদের মধ্যে একটি চুক্তি ছিল, যেখানে রাজার ক্ষমতাকে সীমিত করা হয়েছিল এবং প্রজাদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এটি ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি এবং পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ধারণাকে সমর্থন দিয়েছে।

২. অধিকারের বিল (১৬৮৯): অধিকারের বিল ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের ক্ষমতাকে সীমিত করে এবং সংসদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইনের মাধ্যমে সংসদের অধিকারগুলো সংরক্ষিত হয়েছে, যেমন বাজেট পাসের ক্ষমতা, এবং রাজতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ব্রিটিশ সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

৩. অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট (১৭০১): এই দলিলের মাধ্যমে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটি রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা নির্ধারণ করে এবং রাজতন্ত্রের ক্ষমতা কিভাবে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে পরিচালিত হবে তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। এটি ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. সংসদীয় আইন: ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে সংসদীয় আইন। বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ সংসদে গৃহীত আইনগুলো সংবিধানের অংশ হয়ে যায়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে আইন পাস করা হয় এবং সেই আইনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সংসদীয় আইনগুলির মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে।

আরো পড়ুনঃ যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

৫. ইউরোপীয় কমিউনিটি ল: ব্রিটেন যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ছিল, তখন ইউরোপীয় কমিউনিটির আইনগুলোও ব্রিটিশ সংবিধানের একটি অংশ ছিল। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় এবং সেই সময় থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনগুলো ব্রিটিশ আইনের সঙ্গে সমন্বিত হয়েছিল।

অলিখিত উৎস:

ব্রিটিশ সংবিধানের বড় অংশটি অলিখিত এবং এটি বিভিন্ন প্রথা, বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক রীতিনীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

১. সাংবিধানিক রীতিনীতি: ব্রিটিশ সংবিধানে অনেকগুলো রীতি-নীতি রয়েছে, যা আইন নয়, তবে আইনের মতোই কার্যকর। এগুলো প্রথাগতভাবে অনুসৃত হয় এবং শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ পরিচালনা করে। যেমন, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং মন্ত্রিপরিষদের গঠন একটি সাংবিধানিক রীতিনীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

২. বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত: বিচারবিভাগ ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম শক্তিশালী উৎস। ব্রিটিশ আদালত বিভিন্ন সময়ে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা ও উপধারার ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং সেই সিদ্ধান্তগুলো সংবিধানের অংশ হয়ে যায়। বিচারবিভাগের এই সিদ্ধান্তগুলো আইনগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং শাসনব্যবস্থার সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।

৩. আদর্শসমূহ ও মূল্যবোধ: ব্রিটিশ সংবিধানে বিভিন্ন আদর্শ এবং মূল্যবোধের প্রতিফলন রয়েছে। যেমন গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। এই আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো ব্রিটিশ সংবিধানের অলিখিত উৎস হিসেবে বিবেচিত হয় এবং রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মূল নীতি হিসেবে কাজ করে।

ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলোর মধ্যে সম্পর্ক:

ব্রিটিশ সংবিধানের লিখিত এবং অলিখিত উভয় উৎসের মধ্যে একটি সমন্বয় রয়েছে। লিখিত উৎসগুলো, যেমন সংসদীয় আইন এবং ম্যাগনা কার্টা, অলিখিত উৎসগুলোকে সমর্থন করে এবং প্রয়োজনে ব্যাখ্যা করে। একইভাবে, অলিখিত উৎসগুলোও বিভিন্ন সময়ে লিখিত আইনকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, সাংবিধানিক রীতিনীতি দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত থাকলে সেটি লিখিত আইনের অংশ হয়ে যায়। বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্তগুলিও লিখিত আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং সেই সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিত হয়।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের অভভুদয়ে বাংলা ভাষার অবদান

উপসংহার: ব্রিটিশ সংবিধান, পৃথিবীর প্রাচীনতম সংবিধানগুলোর মধ্যে একটি, বিভিন্ন উৎস থেকে গঠিত হয়েছে। এর লিখিত অংশ যেমন ম্যাগনা কার্টা, অধিকারের বিল এবং সংসদীয় আইনগুলো আইনগত কাঠামো প্রদান করে, তেমনই অলিখিত উৎসগুলো যেমন সাংবিধানিক রীতিনীতি এবং বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত সংবিধানের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। এটি ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত একটি অনন্য সংবিধান, যা বর্তমান বিশ্বের অনেক সংবিধানের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252