বায়োমেট্রিক্স কি? বায়োমেট্রিক্স কিভাবে কাজ করে।

বায়োমেট্রিক্স কি? বায়োমেট্রিক্স কিভাবে কাজ করে।

বায়োমেট্রিক্স হল এমন একটি প্রযুক্তি, যা মানুষের শারীরিক বা আচরণগত বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে সনাক্তকরণের কাজ করে। বায়োমেট্রিক ডেটার মাধ্যমে কোনও ব্যক্তিকে নির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করা যায় কারণ মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন আঙুলের ছাপ, চোখের রেটিনা, কণ্ঠস্বর, বা মুখের গঠন প্রত্যেকের জন্য আলাদা। বায়োমেট্রিক্সের মূল উদ্দেশ্য হল ব্যবহারকারীর পরিচয় যাচাই করা এবং তার ভিত্তিতে বিভিন্ন পরিষেবা বা নিরাপত্তার ব্যবস্থা প্রদান করা।

বায়োমেট্রিক্সের প্রকারভেদ

বায়োমেট্রিক্সকে সাধারণত দুটি প্রধান বিভাগে ভাগ করা হয়: শারীরিক বায়োমেট্রিক্স এবং আচরণগত বায়োমেট্রিক্স।

১. শারীরিক বায়োমেট্রিক্স: এই ধরনের বায়োমেট্রিক্স শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • আঙুলের ছাপ: এটি সবচেয়ে প্রচলিত বায়োমেট্রিক পদ্ধতি, যেখানে ব্যক্তির আঙুলের ছাপের মাধ্যমে পরিচয় যাচাই করা হয়।
  • চোখের রেটিনা বা আইরিস স্ক্যানিং: রেটিনা এবং আইরিসের স্ক্যানের মাধ্যমে খুব নির্ভুলভাবে ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করা যায়।
  • মুখের গঠন: মুখের ত্রিমাত্রিক গঠন এবং বৈশিষ্ট্য যাচাইয়ের মাধ্যমে সনাক্তকরণ সম্ভব।
  • ডিএনএ: ডিএনএ সনাক্তকরণ একটি অত্যন্ত নির্ভুল পদ্ধতি, যা সাধারণত ক্রিমিনাল তদন্তে ব্যবহৃত হয়।

আরো পড়ুনঃ আদিবাসী ও উপজাতির মধ্যে পার্থক্য

২. আচরণগত বায়োমেট্রিক্স: এই পদ্ধতিগুলো ব্যক্তির আচরণগত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এর মধ্যে রয়েছে:

  • কণ্ঠস্বর শনাক্তকরণ: ব্যক্তি বিশেষের কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে পরিচয় যাচাই করা হয়।
  • হাতের স্বাক্ষর: স্বাক্ষর যাচাই পদ্ধতিতে হাতের লেখার ধরণ এবং চাপ ব্যবহারের ভিত্তিতে ব্যক্তির পরিচয় সনাক্ত করা হয়।
  • হাঁটার ধরন: ব্যক্তির হাঁটার ধরন বা গতিবিধির মাধ্যমে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব।

বায়োমেট্রিক্স কিভাবে কাজ করে?

বায়োমেট্রিক্স কাজ করার পদ্ধতিটি বেশ কয়েকটি ধাপে বিভক্ত:

১. ডেটা সংগ্রহঃ প্রথম ধাপে, ব্যবহারকারীর শারীরিক বা আচরণগত বৈশিষ্ট্যগুলি সনাক্ত করা হয় এবং সেগুলির একটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আঙুলের ছাপ বা মুখের স্ক্যান নেওয়া হয়। এই নমুনাগুলি একটি বায়োমেট্রিক সেন্সরের মাধ্যমে নেওয়া হয়, যা ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন হতে পারে। এটি ছবি তুলে বা স্ক্যান করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে।

২. প্রি-প্রসেসিংঃ ডেটা সংগ্রহের পর এটি প্রি-প্রসেসিং বা প্রাথমিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যায়। এই ধাপে, ডেটাকে ফিল্টার করা হয় এবং অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। মূলত এই পর্যায়ে ডেটার গুণগত মান নিশ্চিত করা হয় যাতে পরবর্তী ধাপে এটি কার্যকরভাবে বিশ্লেষণ করা যায়।

৩. ফিচার এক্সট্রাকশনঃ প্রি-প্রসেসিংয়ের পর, ডেটা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা করা হয়, যা ব্যক্তির পরিচয় সনাক্ত করতে সহায়ক। যেমন, আঙুলের ছাপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা আইরিসের ক্ষেত্রে চোখের নির্দিষ্ট অংশগুলিকে ফিচার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখান থেকে প্রাপ্ত তথ্যই সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত হবে।

৪. ডেটাবেজ সংরক্ষণঃ ফিচার এক্সট্রাকশনের পর, সেগুলো একটি নির্দিষ্ট ফর্ম্যাটে সংরক্ষণ করা হয় এবং ব্যবহারকারীর একটি অনন্য প্রোফাইল তৈরি করা হয়। এই প্রোফাইলটি একটি সুরক্ষিত ডেটাবেজে সংরক্ষণ করা হয়। যখনই ব্যবহারকারী তাদের পরিচয় প্রমাণ করতে চান, তখন এই ডেটাবেজ থেকে তুলনা করে সনাক্তকরণ করা হয়।

৫. ম্যাচিং বা সনাক্তকরণঃ যখন ব্যবহারকারী পুনরায় তাদের পরিচয় যাচাই করার জন্য সিস্টেমে প্রবেশ করে, তখন তাদের শারীরিক বা আচরণগত বৈশিষ্ট্য পুনরায় নেওয়া হয়। এরপর এটি ডেটাবেজে সংরক্ষিত নমুনার সাথে তুলনা করা হয়। যদি ডেটা মিলে যায়, তবে ব্যবহারকারীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তার পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত ঘটে এবং ব্যবহারকারী তাৎক্ষণিকভাবে সেবা গ্রহণ করতে পারে।

বায়োমেট্রিক্সের সুবিধা

বায়োমেট্রিক্সের মাধ্যমে পরিচয় সনাক্তকরণ প্রযুক্তি আধুনিক বিশ্বের নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর কিছু প্রধান সুবিধা হল:

১. নিরাপত্তা বৃদ্ধি: বায়োমেট্রিক ডেটা ব্যবহার করে সনাক্তকরণের ফলে নিরাপত্তার মান অনেক বৃদ্ধি পায়। পাসওয়ার্ড বা পিনের পরিবর্তে শারীরিক বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করার ফলে চুরি বা নকল করা অত্যন্ত কঠিন।

আরো পড়ুনঃ ডুরখেইমের যান্ত্রিক সংহতি

২. সহজতা ও সুবিধা: বায়োমেট্রিক্স ব্যবহারকারীদের জন্য সহজ এবং সুবিধাজনক। তাদের আলাদা পাসওয়ার্ড মনে রাখার প্রয়োজন হয় না, যা ভুলে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়।

৩. উন্নত সনাক্তকরণ: বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অত্যন্ত সঠিকভাবে সনাক্তকরণ করা যায়, যা মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার সম্ভাবনা কমায়।

৪. দ্রুতগতির প্রক্রিয়া: বায়োমেট্রিক্স দ্রুত সনাক্তকরণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। আঙুলের ছাপ বা মুখের স্ক্যানের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যবহারকারীর পরিচয় যাচাই করা যায়।

বায়োমেট্রিক্সের সীমাবদ্ধতা

যদিও বায়োমেট্রিক্সের অনেক সুবিধা রয়েছে, এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে:

১. ব্যয়বহুল প্রযুক্তি: বায়োমেট্রিক সিস্টেম স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ব্যয়বহুল হতে পারে, বিশেষ করে উন্নত সেন্সর এবং ডেটাবেজ ব্যবস্থাপনার কারণে।

২. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা: বায়োমেট্রিক ডেটা অত্যন্ত সংবেদনশীল, এবং এটি ভুলভাবে ব্যবহৃত হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য হুমকি হতে পারে। যদি বায়োমেট্রিক ডেটা হ্যাক হয়, তাহলে ব্যক্তির পরিচয় সুরক্ষিত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

৩. ভুল শনাক্তকরণ: কখনো কখনো বায়োমেট্রিক সিস্টেম সঠিকভাবে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হতে পারে। আঙুলের ক্ষত, চোখের সমস্যা বা বয়সের কারণে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হলে ভুল সনাক্তকরণের ঝুঁকি থাকে।

বায়োমেট্রিক্সের ব্যবহার

বায়োমেট্রিক্স বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:

১. মোবাইল ডিভাইস: স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটের সুরক্ষায় বায়োমেট্রিক্স ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফেস রিকগনিশনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা দ্রুত তাদের ডিভাইস আনলক করতে পারেন।

২. বিপণি ও লেনদেন: ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার করে গ্রাহকদের সনাক্তকরণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এটিএম এবং অনলাইন লেনদেনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা কণ্ঠস্বর শনাক্তকরণের মাধ্যমে লেনদেন করা যায়।

আরো পড়ুনঃ রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা

৩. নিরাপত্তা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ: বিমানবন্দর এবং সীমান্তে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভ্রমণকারীদের সনাক্ত করা হয়। এতে সীমান্ত পারাপার ও নিরাপত্তা চেক দ্রুত এবং সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়।

উপসংহারঃ বায়োমেট্রিক্স হল একটি অত্যাধুনিক সনাক্তকরণ পদ্ধতি, যা শারীরিক এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে মানুষের পরিচয় নিশ্চিত করে। এর ব্যবহার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এটি নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতার দিক থেকে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, বিশেষত ব্যক্তিগত । 

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252