১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ও গুরুত্ব

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ও গুরুত্ব বর্ণনা কর।

ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম সাধারণ নির্বাচন । প্রাপ্তবয়স্ক এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন দু’দফায় যথাক্রমে ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ এবং ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রধান দু’টি দল হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ‘আওয়ামী লীগ’ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্যু ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা। অপরদিকে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রচারণার মূল বিষয়বস্তু ছিল- ‘শক্তিশালী কেন্দ্র’, ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ এবং অব্যাহত ভারত বিরোধিতা। নিচে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ও গুরুত্ব তুলে ধরা হলাে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলঃ ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের ফলে ততকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটলে, তার স্থলাভিষিক্ত হোন আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। এবং পূর্ব পাকিস্তানে(বাংলাদেশ) আন্দোলনের ফলে ২৬ মার্চ ১৯৬৯ সালে তিনি ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হোন। তো, ঘোষণা অনুযায়ী, জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয় ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭০। ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল প্রাদেশিক নির্বাচন। ১৯৭০ সালে একই সাথে কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল । কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঐ নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা

জাতীয় পরিষদ: সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ছিল ৩১৩ টি। এর মধ্যে সাধারণ আসন ছিল ৩০০ টি এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ছিল ১৩ টি। ৩১৩ আসনের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৬৯ টি। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৪৪ টি। নির্বাচনি ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামীলীগ পূর্ব-পাকিস্তানের ১৬৯ টি সাধারণ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ মোট ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ১৩৮ টি সাধারণ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ সর্বমোট ৮৮ টি আসন পায়।

প্রাদেশিক পরিষদ: সমস্ত পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের মোট আসন সংখ্যা ছিল ৬২১ টি। নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামীলীগ ৩০০ টি সাধারণ আসনের মধ্যে ২৮৮ এবং সংরক্ষিত ১০ টি আসনের সবকয়টিসহ মোট ২৯৮ টি আসনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপি’র চরম পরাজয় ঘটে। নিম্নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের একটি চার্ট দেওয়া হলো:

দলপ্রার্থীসাধারণ আসনমহিলা আসনমোট
আওয়ামীলীগ৩০০২৮৮১০২৯৮
পিডিপি১৪৪
জামায়াতে ইসলামী১৭৪
ন্যাপ১০৭
স্বতন্ত্র৪৮
মোট৩০০১০৩১০

উপরোক্ত চার্ট থেকে বলা যায় যে, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গের শোষণমূলক কৃতকর্মের জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ফলে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং পিপিপি প্রচুর ভরাডুবিতে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, এ নির্বাচনের ফলাফলই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ প্রশস্ত করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্বঃ

যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ। এজন্য এই নির্বাচনের গুরুত্ব সর্বাধিক। এছাড়া বাঙালি জাতিয়তাবাদ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে বিভিন্ন দিক থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এই নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

১. বাঙালি জাতিয়তাবাদের বিজয় : ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির পর থেকেই বাঙালি জাতি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্যবাদ দাবি করে আসছিল। তবে তৎকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কুচক্রী শাসকবর্গ নানাভাবে তাদেরকে দাবিয়ে রেখেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির সেই জাতিয়তাবাদের বিজয় ঘটে।

২. আঞ্চলিক প্রাধান্য: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ও পিপিপি আঞ্চলিক প্রাধান্য লাভ করে। ফলে উভয় দলই এককভাবে কোনো অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব করার বৈধতা হারায়। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তান শাসন অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়।

৩. স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণ: বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে আন্দোলন করে আসছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ দাবি অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের রায় বাঙালির ছয়দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণ করে।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান

৪. ৬ দফাকে স্বীকৃতি দান : ১৯৬৬ সালে প্রণীত ৬ দফাকে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপকভাবে ভোট প্রদানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে তাদের ন্যায্য দাবি হিসেবে গ্রহণ করেন।

৫. বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ়করণ: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব-বাংলায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তা আরো বেশি সুদৃঢ় হয়।

৬. পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্তির চেতনা অর্জন: পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের উপর শোষণ-নিপিড়নমূলক আচরণ শুরু করে। এমন প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী জনতার চেনতা আরো বেশি বৃদ্ধি পায়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৭. পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক : আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি। অন্যদিকে, Peoples Party পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি। নির্বাচনে এ ধরনের রায় এটাই প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের এক অংশের জনগণ অন্য অংশকে সমর্থন করে না। এ নির্বাচনের রায়ই পাকিস্তানের মৃত্যুর কারণ।

৮. পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব হ্রাস: দীর্ঘ ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ইচ্ছেমতো শাসন ও শোষণ করেছে। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুর ভোটে তাদের পরাজয় ঘটলে দীর্ঘদিনের রাজত্বে অশনি সংকেত দেখা দেয় এবং কর্তৃত্ব হ্রাস পায়, যা তাদের কাছে ছিল চরম অবমাননাকর ও ঈর্ষণীয়।

৯. সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয় লাভের পরও ইয়াহিয়া-ভুট্টো সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। ইয়াহিয়া জতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করে এবং স্থগিত ঘোষণা করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সংগ্রামমুখর হয়ে উঠে। যার প্রেক্ষিতে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।

১০. অধিকার আদায়: সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সকল দিক থেকেই পূর্ব-বাংলার জনগণ লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হয়, তার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ব-বাংলার আপামর জনতা নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্ম হয়।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা

১১. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় এটি ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হয়।

১২. পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের স্বার্থ ও আশাআকাঙ্ক্ষা ভিন্নতার অভিব্যক্তি : এ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক বৃহৎপুঁজি ও সামরিক আমলাচক্রের দৌরাত্ম্যকে বাঙালি জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের দৃষ্টিভঙ্গি স্বার্থ ও আশাআকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ পৃথক।

১৩. সংবিধান প্রণয়ন : একটি দেশ পরিচালনার জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো সংবিধান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণ করেন। কেননা, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান গঠন করা। তাই নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠনের অব্যবহিত পরই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান প্রণয়নের কর্মসূচিতে হাত দেন। তারপর ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সংবিধান বলবৎ ও কার্যকরী হয়।

১৪. স্বাধিকার ও মুক্তি লাভের বহিঃপ্রকাশ: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের রাজনৈতিক তাৎপর্য অধিক। কারণ এটা ছিল বাঙালি জাতির পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় সুদীর্ঘ ২৫ বছরের পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসন ও শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও মুক্তি লাভের বহিঃপ্রকাশ।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধতা প্রমাণিত হয়। বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ সরকারকে বানচাল করার জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এবং ১ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। তাই বলা যায়, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে তোলে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 263