সামাজিক পরিবর্তনের মার্ক্সিয় তত্ত্বটি আলোচনা করো

সামাজিক পরিবর্তনের মার্ক্সিয় তত্ত্বটি আলোচনা করো

ভুমিকাঃ সামাজিক পরিবর্তন মূলত একটি সমাজের সার্বিক ব্যবস্থার পরিবর্তনকে বোঝায়। এতে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তির আচার-আচরণ বা সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন হয়। এটি আর্থ-সামাজিক কাঠামোর একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। সামাজিক পরিবর্তন কিছু জায়গায় দ্রুত হতে পারে আবার কিছু জায়গায় ধীর হতে পারে। তবে, সামাজিক পরিবর্তন একটি সার্বজনীন বিষয়। এটি যেকোন সময় যেকোন স্থানে হতে পারে। তবে, কিছু সামাজিক পরিবর্তন দীর্ঘ সময়ের নানা বিবর্তনের মধ্যদিয়ে পরিবর্তীত হয়।উদাহরণস্বরূপ, সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর।

সামাজিক পরিবর্তন

সামাজিক পরিবর্তন বলতে সমাজ কাঠামো এবং এর কার্যাবলীতে পরিবর্তনকে বোঝায়। মানব সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। সমাজে শুরুতে যা ছিল তা এখন নেই। আজকের পূর্ণতা অনেক পরিবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। সব সমাজই কম বা বেশি পরিবর্তনশীল। কিছু সমাজে পরিবর্তনের গতি খুব দ্রুত এবং অন্যান্য সমাজে পরিবর্তনের গতি ধীর। সামাজিক পরিবর্তনের সংজ্ঞায় বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী তাদের মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন,

গিন্সবার্গ এর মতে, ‘‘সামাজিক পরিবর্তন হল সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন।’’

ম্যাকাইভার বলেন, ‘‘সামাজিক পরিবর্তন হল সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন।’’

আরো পড়ুনঃ মাদকাসক্তি কি? এ সমস্যার সমাধানে একজন সমাজকর্মীর ভূমিকা

লুন্ডবার্গ এর মতে, ‘‘সামাজিক পরিবর্তন বলতে বোঝায় জড়-মানুষের সম্পর্ক এবং এর আচরণের মানগুলোর প্রতিষ্ঠিত নিদর্শনগুলির কোনও পরিবর্তন।’’

সামাজিক পরিবর্তনের মার্ক্সিয় তত্ত্বটি আলোচনা

মার্কসীয় তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মার্কসবাদী দর্শন অনুসারে, সমাজের ভিত্তি হলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা উৎপাদন সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত। উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে উৎপাদন উপকরণগুলির মালিকানা, উৎপাদনের প্রক্রিয়া এবং উৎপাদনের ফসল কীভাবে বণ্টন করা হবে। এই সম্পর্কগুলি সমাজের অন্যান্য দিকগুলিকে, যেমন রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং নীতি, প্রভাবিত করে। মার্কসবাদী তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বগুলি উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে অসাম্য থেকে উদ্ভূত হয়। উদাহরণস্বরূপ, পুঁজিবাদী সমাজে, শ্রমিকরা তাদের শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন করে, কিন্তু উৎপাদনের ফসলগুলি তাদের নিয়ন্ত্রণ করে না। এই অসাম্যটি শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ এবং বিদ্রোহের দিকে পরিচালিত করে।

মার্কসীয় সমাজ কাঠামোর মূল বক্তব্য: Marx এবং তাঁর অনুসারীগণ সমাজ কাঠামোর ব্যাখ্যায় অজৈবিক দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে স্থিতিশীল সত্তা হিসেবে দেখা হয় না, বরং সমাজ ঐতিহাসিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার উদ্ভূত ফসল হিসেবে মনে করা হয়। মার্কস তাঁর ‘Contribution to the Critique of Political Economy’ (1856) তে বলেন, “মানুষ যে সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ তার মধ্যে সে নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের আঙ্গিকে পরস্পরের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। উৎপাদন সম্পর্কগুলো অপরিহার্য এবং ব্যক্তির ইচ্ছা নিরপেক্ষ। 

এ উৎপাদন সম্পর্কগুলো উৎপাদনের বস্তুগত শক্তিসমূহের বিকাশের সুনির্দিষ্ট স্তরের প্রতিষঙ্গিক। উৎপাদন সম্পর্কসমূহের যোগফল সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করে। এটি সমাজের প্রকৃত ভিত্তি, যার উপর তৈরি হয় আইনি ও রাজনৈতিক উপরি কাঠামো এবং প্রতিষঙ্গিক নির্দিষ্ট সামাজিক চেতনা। অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন সমগ্র উপর কাঠামোর পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।” উপর্যুক্ত বক্তব্যের মাধ্যমেই সমাজ কাঠামোর রূপ সম্পর্কে মার্কস যা বলেছেন তা ফুটে উঠে। এখানে সমাজ কাঠামোর দুটি দিক স্পষ্ট । যথা :

১. অর্থনৈতিক কাঠামো যাকে মৌল কাঠামো বা (Basic structure) বলা হয়ে থাকে ।

২. উপরি কাঠামো (Super structure) যা বস্তুত মৌল কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। 

আরো পড়ুনঃ বেকারত্ব কি? বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণের উপায় সমূহ বর্ণনা কর

প্রথমেই আমাদের জানা উচিত মার্কস অর্থনৈতিক কাঠামো এবং উপরি কাঠামো বলতে কি বুঝিয়েছেন। মার্কসের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে তিনি মানুষের বস্তুগত জীবন বা উৎপাদন পদ্ধতিকে মৌল কাঠামো এবং মানুষের চৈতন্য ও ভাবনা প্রসূত বিষয়গুলোকে উপরি কাঠামো বলেছেন। মার্কস সমাজজীবনকে রূপক অর্থে সৌধের সাথে তুলনা করেছেন। সৌধ যেমন তার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি ব্যক্তির মননশীলতা, চিন্তাশীলতা, জ্ঞানমণ্ডল সমাজের বস্তুগত জীবনের উপর দণ্ডায়মান। আবার বস্তুগত জীবনের পরিবর্তনের ফলে সমাজের উপরি কাঠামোর পরিবর্তন

অর্থনৈতিক বা মৌল কাঠামো: মার্কস ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অর্থনৈতিক কাঠামো বলতে তিনি সমগ্র উৎপাদন শক্তি, উৎপাদন সম্পর্ক বা শ্রেণি সম্পর্ককে বুঝিয়েছেন। উৎপাদনের যন্ত্রের মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণির সম্পর্ককে তিনি সমাজ কাঠামোর ভিত্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। উৎপাদনের উপায় যেমন- যন্ত্রপাতি, শ্রম, দক্ষতা, প্রযুক্তি ইত্যাদি হলো উৎপাদন শক্তি। অন্যদিকে, উৎপাদন উপায়ের সম্পর্ক, সম্পদের মালিকানা ইত্যাদি হলো উৎপাদন সম্পর্ক।

মার্কসবাদী তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তন একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া: প্রতিটি সমাজের নিজস্ব অনন্য ইতিহাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে, যা সামাজিক পরিবর্তনের পথকে প্রভাবিত করে। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন যে সামাজিক পরিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা একটি সমাজের বিকাশের সাথে সাথে ঘটে। মার্কসীয় তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তনের ফলাফল হলো একটি নতুন সমাজের প্রতিষ্ঠা। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস হবে। বিপ্লবের ফলে একটি নতুন সমাজ গড়ে উঠবে, যেখানে উৎপাদন সম্পর্কের উপর শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

আরো পড়ুনঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

মার্কসীয় তত্ত্বের সামাজিক পরিবর্তনের উপর প্রভাব: মার্কসীয় তত্ত্ব সামাজিক পরিবর্তনকে একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে, যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বন্দ্বের কারণে ঘটে। এই তত্ত্বটি সামাজিক পরিবর্তনের উপর অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মার্কসীয় তত্ত্ব সামাজিক পরিবর্তনের একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে চিহ্নিত করেছে। এই তত্ত্বটি প্রমাণ করে যে প্রতিটি সমাজের নিজস্ব অনন্য ইতিহাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে, যা সামাজিক পরিবর্তনের পথকে প্রভাবিত করে। মার্কসীয় তত্ত্ব সামাজিক পরিবর্তনের একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করেছে। এই তত্ত্বটি প্রমাণ করে যে সামাজিক পরিবর্তন প্রায়শই বিপ্লবের মাধ্যমে ঘটে, যা শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ফলে ঘটে।

মার্কসীয় তত্ত্বের সমালোচনা:

মার্কসীয় তত্ত্বকে প্রায়শই অতি-আশাবাদী বলে সমালোচনা করা হয়। এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস হবে। তবে, অনেক সমালোচক বিশ্বাস করেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি স্থিতিশীল এবং বিপ্লব ঘটতে পারে না। মার্কসীয় তত্ত্বকে প্রায়শই অতি-সরলীকৃত বলে সমালোচনা করা হয়। এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করে যে সামাজিক পরিবর্তন একটি সরল দ্বন্দ্বের ফলাফল। তবে, অনেক সমালোচক বিশ্বাস করেন যে সামাজিক পরিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার অনেক কারণ রয়েছে।

উপসংহার: মার্কসীয় তত্ত্ব সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। এই তত্ত্বটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভূমিকা, সামাজিক পরিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া এবং সামাজিক পরিবর্তনের রাজনৈতিক প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252