নগরায়ন কি?

নগরায়ন কি?

ভূমিকা: নগরায়ণ (Urbanization) হল সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে দিন দিন আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও ভৌগোলিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল বা অপেক্ষাকৃত কম উন্নত অঞ্চলসমূহ ধীরে ধীরে নগরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। নগরায়ণের ফলে জীবনযাত্রার উন্নতি হয়, তবে একই সঙ্গে এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। আধুনিক শিল্প, বাণিজ্য এবং জীবনযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নগরগুলো আবির্ভূত হয়েছে, যা সমাজের অবকাঠামোগত পরিবর্তন ও জনসংখ্যার কেন্দ্রীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

নগরায়ণের সংজ্ঞা:

নগরায়ণ বলতে সাধারণত সেই প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে একটি সমাজ বা অঞ্চল নগরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, এবং মানুষের একটি বড় অংশ গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। নগরায়ণের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন এবং সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সহজভাবে বলতে গেলে, এটি গ্রামীণ জনসংখ্যার শহরাঞ্চলে স্থানান্তর এবং শহরের জীবনযাত্রার প্রভাবকে বোঝায়।

আরো পড়ুনঃ সমাজকর্মের সাথে সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক নিরূপণ

প্রামাণ্য সংজ্ঞা:

বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ নগরায়ণের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নিম্নরূপ:

  • Kingsley Davis এর মতে, “নগরায়ণ হল সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ অংশ শহরে বসবাস শুরু করে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শহরকেন্দ্রিক হয়।”
  • UN Habitat নগরায়ণকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে: “নগরায়ণ একটি প্রক্রিয়া যেখানে জনসংখ্যার স্থানান্তর ঘটে এবং গ্রামীণ এলাকা শহরে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রা, অবকাঠামো, এবং সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়।”

নগরায়ণের কারণ:

নগরায়ণ একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার পেছনে অনেক কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো:

  1. শিল্পায়ন: শিল্প বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন কারখানা ও উৎপাদন কেন্দ্র শহরের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজের সন্ধানে মানুষ শহরমুখী হয় এবং নগরায়ণের ধারা শুরু হয়।
  2. কর্মসংস্থানের সুযোগ: শহরগুলোতে উন্নত চাকরির সুযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উচ্চ আয়ের সম্ভাবনা গ্রামীণ জনসংখ্যাকে শহরে আসতে উৎসাহিত করে।
  3. শিক্ষার উন্নয়ন: নগরায়ণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ গ্রামীণ জনসংখ্যাকে শহরের দিকে আকৃষ্ট করে।
  4. স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো: শহরগুলোতে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা মানুষের জীবনের মান উন্নত করে। ফলে গ্রামীণ জনগণ শহরে বসবাস করতে চায়।
  5. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক কারণে নগরায়ণ দ্রুততর হয়। শহরগুলোতে ব্যবসা, শিল্প ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৃদ্ধি নগরায়ণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

নগরায়ণের প্রভাব:

১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: নগরায়ণ দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করে। শহরগুলো শিল্প, বাণিজ্য ও সেবাখাতের কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে ওঠে। এটি কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করে।

আরো পড়ুনঃ নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

২. জীবনযাত্রার উন্নতি: নগরায়ণের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবহন, বাসস্থান এবং বিনোদনের সুযোগ পাওয়া যায়।

৩. সামাজিক পরিবর্তন: নগরায়ণ সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ, এবং জীবনধারায় পরিবর্তন ঘটে। নগরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে, যা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বাড়ায়।

৪. নগর সংকট: নগরায়ণের ফলে দ্রুত নগরবৃদ্ধি হলে তা অবকাঠামোগত সংকট সৃষ্টি করে। অধিক জনসংখ্যার কারণে যানজট, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, বায়ু ও পানি দূষণ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

৫. অপরিকল্পিত নগরায়ণ: অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ আবাসন, বস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি, অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নগরায়ণ:

বাংলাদেশের নগরায়ণ দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকাসহ অন্যান্য প্রধান শহরগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। বাংলাদেশের নগরায়ণের প্রধান কারণ হলো কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন এবং গ্রামাঞ্চলে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতার অভাব। ঢাকায় শ্রমিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অপরিকল্পিত নগরায়ণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবেশ দূষণ, বস্তি সম্প্রসারণ, যানজট এবং অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।

নগরায়ণের সমাধান:

নগরায়ণের ইতিবাচক দিকগুলোকে আরও সুসংহত করতে এবং নেতিবাচক দিকগুলো দূর করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

  1. অপরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণ: সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
  2. পরিবেশ সংরক্ষণ: নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় আরও উন্নত পরিবেশ সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
  3. নগর পরিকল্পনা: অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য উন্নত ও টেকসই নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে নগরের অবকাঠামো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপিত হয়।

উপসংহার: নগরায়ণ আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবগুলি মোকাবিলা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সঠিক নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে নগরায়ণের সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি টেকসই ও উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252