দারিদ্র্যের কারণ

দারিদ্র্যের কারণ

ভূমিকা: দারিদ্র্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা মানুষের জীবনযাত্রার মান, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অভাবকে বোঝায়। দারিদ্র্যের ফলে মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা প্রাপ্তির সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। দারিদ্র্য শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সমস্যা, যা সমাজের সার্বিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে।

দারিদ্র্যের পেছনে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা আরও প্রকটভাবে দেখা যায়। নিম্নে দারিদ্র্যের কিছু প্রধান কারণ বিশ্লেষণ করা হলো:

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য: অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ। ধনী এবং গরিবের মধ্যে সম্পদের অসম বণ্টন এবং আয়ের পার্থক্য দরিদ্রদের আরও দরিদ্র করে তুলছে। ধনীদের সম্পদের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্রদের আয় ও সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে না। আয়ের এই বৈষম্যের কারণে দরিদ্র মানুষরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, ফলে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশে ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্যের প্রধান চালিকাশক্তি।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে সমাজকর্ম পদ্ধতির গুরুত্ব

২. অশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের অভাব: অশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের অভাবও দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ। শিক্ষা মানবসম্পদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি জাতির উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু শিক্ষার অভাবে মানুষ দক্ষতা অর্জন করতে পারে না, ফলে তারা উন্নত কাজ বা কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে মানুষ দরিদ্র অবস্থায় থেকে যায়। বাংলাদেশে শিক্ষার অভাব ও কর্মসংস্থানের সংকট দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত।

৩. জনসংখ্যা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর চাপ সৃষ্টি করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমি, খাদ্য, পানি এবং অন্যান্য সম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে, যার ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। একটি দেশের সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হলে তা দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্য সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা প্রভৃতি নিয়মিত ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দারিদ্র্যের চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা তাদের আয়-রোজগারের সুযোগ হারিয়ে ফেলে এবং পুনরায় সম্পদ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৫. ভূমিহীনতা: ভূমিহীনতা দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। গ্রামীণ এলাকায় অনেক মানুষ ভূমি থেকে বঞ্চিত। কৃষিজীবী মানুষদের জন্য ভূমি আয়ের প্রধান উৎস, কিন্তু যারা ভূমিহীন, তারা আয়-রোজগারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে তারা দারিদ্র্যের শিকার হয় এবং সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে থেকে যায়।

আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পদ্ধতি কাকে বলে?

৬. অপরিকল্পিত নগরায়ন: অপরিকল্পিত নগরায়নও দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ। অনেক মানুষ গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে শহরে আসে, কিন্তু শহরে তাদের জন্য পর্যাপ্ত কাজ বা বাসস্থানের সুযোগ থাকে না। ফলে তারা বস্তিতে বসবাস করতে বাধ্য হয় এবং নিম্নমানের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে শহরে বেকারত্ব, অপরাধপ্রবণতা ও দারিদ্র্যের হার বাড়ছে।

৭. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও দারিদ্র্যের একটি কারণ। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় এবং বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চান না। এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায় এবং অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা দারিদ্র্য বাড়ায়।

দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায়:

দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন:

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস: অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসের জন্য ধনী-গরিবের মধ্যে আয়ের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধনীদের উপর কর আরোপ করে দরিদ্রদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

২. শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা দরকার। শিক্ষিত মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে, যা দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে।

৩. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন জরুরি।

৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পূর্বাভাস ব্যবস্থা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৫. কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ: দেশে শিল্পায়ন ও নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে দরিদ্র মানুষ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয় করতে পারে।

আরো পড়ুনঃ গ্রামীণ সমাজসেবা কি

উপসংহার: দারিদ্র্য একটি জটিল সামাজিক সমস্যা, যার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 252