দারিদ্রের দুষ্টুচক্র কাকে বলে
ভূমিকা: দারিদ্রতা দীর্ঘকাল ধরে সমগ্র পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও অনেক সময় এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যেখানে তারা আরও বেশি দারিদ্র্যের মধ্যে আটকে পড়ে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র।
দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র:
দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র বলতে এমন একটি চক্রকে বোঝায়, যেখানে দরিদ্র মানুষেরা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও তারা এক পর্যায়ে আবারও দরিদ্রতার মধ্যে ফিরে আসে। অর্থাৎ, তারা নিজেদের আয় ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং আবারো দরিদ্রতার আবর্তে আবদ্ধ হয়। এই চক্রটি সাধারণত উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
অধ্যাপক রাগনার নারকস এই দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র সম্পর্কে একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়েছেন: “A country is poor because it is poor.” অর্থাৎ, একটি দেশ দরিদ্র কারণ এটি দরিদ্র অবস্থায় আটকে রয়েছে। নারকসের মতে, দরিদ্রতার এই চক্রে একবার ঢুকে গেলে সেই চক্র থেকে বের হওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ এক দারিদ্র্য সমস্যা অন্য সমস্যার জন্ম দেয়।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে সমাজকর্ম পদ্ধতির গুরুত্ব
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের ধাপসমূহ:
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে কয়েকটি ধাপ রয়েছে, যেগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত। এই ধাপগুলোকে একটি চিত্রের মাধ্যমে বোঝানো যায়:
১. স্বল্প উৎপাদন: দরিদ্র দেশগুলোতে উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কম থাকে, কারণ তাদের পর্যাপ্ত সম্পদ বা প্রযুক্তিগত সুবিধা নেই।
২. স্বল্প আয়: উৎপাদন কম হওয়ায় আয়ও কমে যায়। এর ফলে জনগণ পর্যাপ্ত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়।
৩. স্বল্প বিনিয়োগ: কম আয় হওয়ার ফলে বিনিয়োগের পরিমাণও কম হয়, কারণ বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন ও আয় তাদের নেই।
- স্বল্প মূলধন: দরিদ্র মানুষের হাতে মূলধন কম থাকার ফলে তারা নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে বা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিনিয়োগ করতে পারে না।
এই ধাপগুলো একটি চক্রের মতো ঘুরতে থাকে। যেহেতু আয় ও বিনিয়োগ কম, তাই উৎপাদনও কম থাকে, এবং আবারও আয় কম হয়। এভাবেই দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র ক্রমাগত চলতে থাকে এবং দরিদ্র মানুষেরা চক্রের মধ্যে আটকে পড়ে।
আরো পড়ুনঃ সমাজকর্ম পদ্ধতি কাকে বলে?
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের প্রভাব:
- অর্থনৈতিক স্থবিরতা: উৎপাদন ও আয় কম থাকায় একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধীর গতিতে চলে।
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে বাধা: দরিদ্র মানুষ তাদের শিশুদের শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত খরচ করতে পারে না, ফলে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও দরিদ্র থেকে যায়।
- অবকাঠামো উন্নয়নের অভাব: দরিদ্র দেশগুলোতে বিনিয়োগের অভাবে সঠিক অবকাঠামো তৈরি করা যায় না, যা উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
- দারিদ্র্যের সম্প্রসারণ: দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের কারণে দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পায় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা বিস্তৃত হয়।
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তির উপায়:
দারিদ্র্যের এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কিছু পদক্ষেপ নিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেমন:
১. বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
২. শিক্ষার প্রসার: দরিদ্রদের জন্য শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে তাদের আয়ের উৎস ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
৩. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে তারা তাদের উৎপাদনশীলতা ও আয় বাড়াতে সক্ষম হবে।
৪. সরকারি সহায়তা: দরিদ্র মানুষদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং সরকারি সহায়তা প্রয়োজন, যাতে তারা দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
আরো পড়ুনঃ দারিদ্র্যের কারণ
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করতে পারে।
উপসংহার: দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র একটি জটিল সমস্যা, তবে সঠিক পদক্ষেপ ও কার্যকর নীতি গ্রহণের মাধ্যমে এই চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। যেসব দেশ একসময় দারিদ্র্যের এই দুষ্টচক্রে আবদ্ধ ছিল, তারা সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পেরেছে, এবং তা আমাদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে রয়েছে।