নিউটনের তৃতীয় সূত্র কি?

Avatar
calender 09-11-2025

নিউটনের তৃতীয় সূত্র পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই সূত্রটি মূলত বল (Force) এবং তার প্রতিক্রিয়া (Reaction)-এর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। আইজ্যাক নিউটন ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “Philosophiæ Naturalis Principia Mathematica”–তে এই সূত্রটি প্রকাশ করেন। সহজভাবে বলতে গেলে, নিউটনের তৃতীয় সূত্র আমাদের শেখায়—কোনো বস্তুর উপর যখন একটি বল প্রয়োগ করা হয়, তখন সেই বস্তু সমান মানের কিন্তু বিপরীত দিকে একটি প্রতিক্রিয়াবল প্রয়োগ করে।

নিচে সূত্রটির বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ তুলে ধরা হলো—

  • সূত্রের মূল বাক্য: নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী— “প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত একটি প্রতিক্রিয়া থাকে।” অর্থাৎ, যদি কোনো বস্তু A অন্য বস্তু B-এর উপর একটি বল প্রয়োগ করে, তাহলে B-ও একই সময়ে A-এর উপর সমান মানের কিন্তু বিপরীতমুখী একটি বল প্রয়োগ করবে।

  • গাণিতিক প্রকাশ:
    যদি বস্তু A বস্তু B-এর উপর একটি বল F₁₂ প্রয়োগ করে, তাহলে বস্তু B বস্তু A-এর উপর একটি বল F₂₁ প্রয়োগ করবে, এবং এই দুই বলের মধ্যে সম্পর্ক হলো:
    F₁₂ = -F₂₁
    এখানে ঋণাত্মক চিহ্নটি বলের দিক বিপরীত হওয়ার নির্দেশ দেয়।

  • উদাহরণ:
    যখন আমরা দেয়ালকে ঠেলি, দেয়ালও আমাদের হাতে সমান বল ফিরিয়ে দেয়। আমরা যদি টেবিলের উপর বই রাখি, টেবিল বইটিকে সমান বল দিয়ে ঠেলে রাখে, ফলে বইটি নিচে পড়ে না। একইভাবে, হাঁটার সময় আমাদের পা মাটিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়, আর মাটি আমাদের শরীরকে সামনে এগিয়ে দেয়—এই ঘটনাটিও নিউটনের তৃতীয় সূত্রের উদাহরণ।

  • সূত্রের বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য:
    এই সূত্রটি বল ও গতির পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝার মূল ভিত্তি। এটি প্রমাণ করে যে প্রকৃতিতে বল কখনো একা থাকে না, বরং যুগলভাবে কাজ করে। প্রতিটি ক্রিয়ার সাথে একটি প্রতিক্রিয়া সবসময় যুক্ত থাকে।

  • দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ:

    • রকেট উৎক্ষেপণ: রকেটের ইঞ্জিন যখন গ্যাস নিচের দিকে বের করে দেয়, তখন গ্যাসের বিপরীত প্রতিক্রিয়া রকেটকে উপরের দিকে ঠেলে দেয়।

    • বন্দুকের রিকয়েল: বন্দুক থেকে গুলি বের হওয়ার সময় গুলি সামনে চলে যায়, কিন্তু বন্দুকটি সমান প্রতিক্রিয়ায় পিছনে ধাক্কা খায়।

    • নৌকা চালানো: দাঁড় দিয়ে পানিকে পিছনের দিকে ঠেলা হয়, আর সেই প্রতিক্রিয়ায় নৌকাটি সামনে অগ্রসর হয়।

    • হাঁটা বা দৌড়ানো: আমরা মাটিকে পিছনের দিকে ঠেলি, মাটিও আমাদের পা-কে সামনে ঠেলে দেয়।

  • সূত্রটির সীমাবদ্ধতা:
    নিউটনের তৃতীয় সূত্র কেবলমাত্র ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সে পুরোপুরি প্রযোজ্য। খুব ক্ষুদ্র স্তরে (যেমন—পারমাণবিক বা কোয়ান্টাম পর্যায়ে) কিংবা আলোর গতির কাছাকাছি অবস্থায় কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়, যেখানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করা হয়।

  • গুরুত্ব:
    এই সূত্রটি শুধু পদার্থবিদ্যার জন্য নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য বোঝার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেখায় যে প্রতিটি ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সমতা বজায় থাকে, যা মহাবিশ্বের গতিশীলতার মূল রহস্য।

সব মিলিয়ে বলা যায়, নিউটনের তৃতীয় সূত্র কেবল একটি পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র নয়, এটি প্রকৃতির সমতা ও পারস্পরিক নির্ভরতার প্রতীক। এটি আমাদের শেখায়—প্রত্যেক কর্মেরই একটি প্রতিক্রিয়া আছে, যা একে অপরের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে মহাবিশ্বের গতিশীলতা বজায় রাখে।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD