শব্দ কাকে বলে? শব্দ কত প্রকার ও কী কী?
শব্দ হলো অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টি, যা দ্বারা চিন্তা, ভাব বা অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, শব্দ হচ্ছে ভাষার ক্ষুদ্রতম স্বতন্ত্র একক যা নিজে একটি নির্দিষ্ট অর্থ বহন করে। অর্থাৎ শব্দ এমন একটি ধ্বনিসমষ্টি, যা উচ্চারণে বা লেখায় অর্থের মাধ্যমে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করে। যেমন – ‘মানুষ’, ‘জল’, ‘ভালো’, ‘চল’ ইত্যাদি শব্দের মধ্যেই স্বতন্ত্র অর্থ নিহিত থাকে।
শব্দ মানুষের যোগাযোগের মূল ভিত্তি। কোনো ভাষায় যত বেশি শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়, সেই ভাষার প্রকাশক্ষমতাও তত বেশি হয়। শব্দের মাধ্যমেই বাক্য গঠিত হয় এবং ভাষা অর্থবহ হয়ে ওঠে।
শব্দকে মূলত দুটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়—ধ্বনিগত ও অর্থগত। ধ্বনিগত দিক থেকে শব্দ হলো একগুচ্ছ ধ্বনির সংমিশ্রণ, আর অর্থগত দিক থেকে শব্দ একটি ধারণা বা অর্থ প্রকাশ করে।
শব্দের প্রকারভেদ
বাংলা ভাষায় শব্দকে সাধারণত কয়েকভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়—গঠন অনুসারে, উৎপত্তি অনুসারে, ও অর্থের ভিত্তিতে। নিচে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
গঠন অনুসারে শব্দ তিন প্রকার
-
মূল শব্দ: যে শব্দ কোনো অংশে বিভক্ত নয় এবং নিজের মধ্যেই অর্থসম্পূর্ণ, তাকে মূল শব্দ বলে। যেমন – জল, মাটি, ফুল, মান।
-
যৌগিক শব্দ: দুটি বা ততোধিক মূল শব্দ যুক্ত হয়ে নতুন অর্থ প্রকাশ করলে তাকে যৌগিক শব্দ বলে। যেমন – জলধারা, মানুষত্ব, জীবনযাত্রা।
-
রূঢ় শব্দ: যেসব যৌগিক শব্দের অর্থ তাদের অংশবিশেষের অর্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়, সেগুলোকে রূঢ় শব্দ বলে। যেমন – রক্তচক্ষু (অর্থ: ভয়ানক রাগ), কাকতালীয় (অর্থ: আকস্মিক মিল)।
উৎপত্তি অনুসারে শব্দ চার প্রকার
-
তদ্ভব শব্দ: প্রাচীন ভাষা (সংস্কৃত) থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে এমন শব্দকে তদ্ভব বলে। যেমন – ঘর (গৃহ), মাছ (মৎস্য), জল (জল)।
-
তৎসম শব্দ: সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিত অবস্থায় গৃহীত শব্দকে তৎসম বলে। যেমন – ধর্ম, কর্ম, নর, নারী।
-
দেশজ শব্দ: বাংলা ভাষার নিজস্বভাবে উৎপন্ন শব্দকে দেশজ বলে। যেমন – ঝুম, টকটকে, পটপট, টিপটিপ।
-
বিদেশি শব্দ: বিদেশি ভাষা থেকে গৃহীত শব্দকে বিদেশি শব্দ বলে। যেমন – স্কুল (ইংরেজি), হুজুর (আরবি), কুলফি (ফারসি)।
অর্থের ভিত্তিতে শব্দ চার প্রকার
-
সমার্থক শব্দ: একাধিক শব্দে একই অর্থ বোঝালে সেগুলো সমার্থক শব্দ। যেমন – জল ও পানি, দুঃখ ও বেদনা।
-
বিপরীতার্থক শব্দ: দুটি শব্দে পরস্পর বিপরীত অর্থ প্রকাশ করলে সেগুলো বিপরীতার্থক শব্দ। যেমন – সুখ ও দুঃখ, আলো ও অন্ধকার।
-
সমোচ্চারিত শব্দ: যেসব শব্দ উচ্চারণে এক হলেও অর্থে ভিন্ন, সেগুলো সমোচ্চারিত শব্দ। যেমন – কল (যন্ত্র) ও কল (গাছের ডাল)।
-
বহুার্থক শব্দ: এক শব্দে একাধিক অর্থ বোঝালে তা বহুার্থক শব্দ। যেমন – মুখ (মানুষের অঙ্গ), মুখ (বাড়ির সামনের দিক), মুখ (নদীর মোহনা)।
| প্রকারভেদ | উদাহরণ | বৈশিষ্ট্য |
|---|---|---|
| মূল শব্দ | জল, মাটি, ফুল | বিভক্ত নয়, নিজেই অর্থবহ |
| যৌগিক শব্দ | জীবনযাত্রা, রক্তচক্ষু | দুটি বা ততোধিক মূল শব্দের সমন্বয় |
| তদ্ভব শব্দ | ঘর, মাছ | সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত |
| তৎসম শব্দ | ধর্ম, কর্ম | অপরিবর্তিতভাবে সংস্কৃত থেকে আগত |
| দেশজ শব্দ | ঝুম, টকটকে | বাংলার নিজস্ব শব্দ |
| বিদেশি শব্দ | স্কুল, হুজুর | বিদেশি উৎস থেকে গৃহীত |
শব্দের এই শ্রেণিবিন্যাস আমাদের ভাষার গঠন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তন বোঝায়। শব্দের সঠিক প্রয়োগ ও প্রকার সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে ভাষা আরও শুদ্ধ, সাবলীল ও অর্থবহ হয়।
অতএব বলা যায়, শব্দ হলো ভাষার প্রাণ, যা ধ্বনির মাধ্যমে অর্থ প্রকাশ করে এবং চিন্তা বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হিসেবে মানব সভ্যতার বিকাশে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে।