জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝ?

Avatar
calender 09-11-2025

জাতীয়তাবাদ বলতে বোঝ এক ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা, যার মূল লক্ষ্য হলো একটি জাতির ঐক্য, স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা এবং জাতির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশ করা। এটি এমন এক মানসিক ও সামাজিক শক্তি, যা মানুষকে তার জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখণ্ডের প্রতি নিবিড়ভাবে আবদ্ধ রাখে। জাতীয়তাবাদ মূলত সেই ধারণাকে শক্তিশালী করে যে—এক জাতি নিজস্ব স্বকীয়তা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।

জাতীয়তাবাদ ইতিহাসে বহু রাষ্ট্রগঠনের প্রেরণা দিয়েছে এবং একে বলা হয় রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণশক্তি। এটি শুধু রাজনৈতিক ধারণা নয়, বরং এক ধরনের জাতিগত চেতনা, যেখানে মানুষ নিজের জাতির স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখে।

জাতীয়তাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য:
জাতীয়তাবাদকে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি প্রধান দিক পাওয়া যায়—

  • এটি জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে গঠিত একটি ঐক্যবদ্ধ চিন্তাধারা।

  • ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভূখণ্ড—এই উপাদানগুলো জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়ে তোলে।

  • জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই এর প্রধান উদ্দেশ্য।

  • এটি মানুষকে আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও ঐক্যের পথে উদ্বুদ্ধ করে।

  • জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি মানসিক মুক্তিরও প্রতীক।

উপাদান ব্যাখ্যা উদাহরণ
ভাষা জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাহক বাংলা ভাষা আন্দোলন
ভূখণ্ড রাষ্ট্রীয় সীমানা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশের স্বাধীন ভূখণ্ড
সংস্কৃতি জাতির ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের নিদর্শন বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য
ইতিহাস জাতির গৌরবময় অতীত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
ধর্ম/বিশ্বাস মানসিক ও নৈতিক বন্ধন ধর্মীয় সহনশীলতা ও ঐক্য

জাতীয়তাবাদের ধরন:
জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়—

  • রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ: রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন—যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

  • সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ: নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ—যেমন রবীন্দ্রনাথের “বাংলাভাষার জয়” চেতনা।

  • অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ: জাতীয় সম্পদ ও অর্থনীতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চিন্তা।

  • ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ: ধর্মভিত্তিক বিভাজন নয়, বরং মানবিক ঐক্যের ভিত্তিতে জাতিগত সংহতি গঠন।

জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
জাতীয়তাবাদ ইউরোপে ১৮শ ও ১৯শ শতকে উদ্ভূত হয়, বিশেষ করে ফরাসি বিপ্লব (1789) এর পর। এই বিপ্লবই প্রথমবার “জাতি” ধারণাকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে এটি এশিয়া ও আফ্রিকায় স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের মূল শিকড় নিহিত রয়েছে ভাষা আন্দোলন (১৯৫২)মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)-এ। এ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপ ও শক্তিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।

জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক দিক:

  • এটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করে।

  • জাতির আত্মপরিচয় ও গৌরববোধ জাগিয়ে তোলে।

  • রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য রক্ষায় প্রেরণা দেয়।

  • সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করে।

  • নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে।

জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক দিক:
যদিও জাতীয়তাবাদ ইতিবাচক শক্তি হিসেবে কাজ করে, কিন্তু চরমপন্থী রূপে এটি বিভেদও সৃষ্টি করতে পারে—

  • অতিরিক্ত জাতিগত গর্ব অন্য জাতির প্রতি বৈরিতা সৃষ্টি করতে পারে।

  • জাতীয়তাবাদ কখনও সাম্রাজ্যবাদী বা বর্ণবাদী মনোভাবের জন্ম দেয়।

  • ধর্ম, ভাষা বা জাতিগত বিভাজনের মাধ্যমে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ ঘটাতে পারে।

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের প্রয়োগ:
বাংলাদেশের জন্মই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। এখানে জাতীয়তাবাদ ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা—এই তিনটি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে।

  • ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা করে।

  • ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার পরিণতি এনে দেয় স্বাধীন রাষ্ট্রের মাধ্যমে।

  • পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা” মূলনীতিগুলো সংরক্ষিত হয়।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদ:
বর্তমান বৈশ্বিক যুগে জাতীয়তাবাদ কেবল ভূখণ্ডগত ধারণায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি এখন সাংস্কৃতিক পরিচয়, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাডিজিটাল সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও জাতীয়তাবাদ একটি সচেতনতা আন্দোলনে রূপ নিয়েছে, যেখানে তরুণ প্রজন্ম দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি গর্ববোধ প্রকাশ করছে।

সর্বোপরি, জাতীয়তাবাদ হলো জাতির আত্মচেতনা ও স্বাধীনতার প্রতীক, যা মানুষকে তার দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত করে। এটি শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং এক মানসিক বন্ধন যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখে এবং তাকে তার অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামী ও গৌরবান্বিত করে তোলে।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD