কৃষি কী?

কৃষি মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন ও মৌলিক কার্যকলাপ। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ মাটি, পানি, সূর্যের আলো ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে খাদ্য, পশুখাদ্য, তন্তু ও নানা প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন করে।
কৃষির মাধ্যমেই মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। ইতিহাসের শুরু থেকেই কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদনের উপায় নয়, এটি মানবজীবনের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
কৃষির সংজ্ঞা: কৃষি হলো ভূমি চাষ, বীজ বপন, ফসল উৎপাদন, পশুপালন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের প্রক্রিয়া। আরও বলা যায়, কৃষি হচ্ছে ফসল, গবাদিপশু, মাছ ও বনজ সম্পদ উৎপাদনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।
শব্দের উৎপত্তি: ‘কৃষি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘কৃষ’ থেকে, যার অর্থ হলো চাষ বা ভূমি কর্ষণ। এটি মূলত মাটি ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশ করে।
কৃষির মূল উদ্দেশ্য: কৃষির প্রধান উদ্দেশ্য হলো খাদ্য উৎপাদন। তবে এর সঙ্গে জড়িত আরও অনেক উদ্দেশ্য রয়েছে, যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পশুপালন, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা।
কৃষির প্রধান শাখা: কৃষিকে সাধারণত কয়েকটি শাখায় ভাগ করা যায়—
-
ফসল চাষ (Crop farming): ধান, গম, ভুট্টা, সবজি, ফল ইত্যাদি উৎপাদন।
-
পশুপালন (Animal husbandry): গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি ইত্যাদির যত্ন ও প্রজনন।
-
মৎস্যচাষ (Fishery): মাছ ও জলজ প্রাণী উৎপাদন।
-
বনায়ন (Forestry): বন সংরক্ষণ ও কাঠজাত পণ্য উৎপাদন।
-
উদ্যানপালন (Horticulture): ফল, ফুল, ও শাকসবজি উৎপাদনের বিশেষায়িত চাষ।
কৃষির গুরুত্ব: কৃষি শুধু খাদ্য সরবরাহ করে না, বরং একটি দেশের অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে কৃষি খাত GDP, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস।
অর্থনৈতিক ভূমিকা: কৃষি শিল্প খাতের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করে—যেমন পাট, তুলা, আখ, তামাক ইত্যাদি। এছাড়া কৃষিভিত্তিক শিল্প যেমন খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ, দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন ও মাছ সংরক্ষণ কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
পরিবেশগত ভূমিকা: কৃষি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বৃক্ষরোপণ, মাটির সংরক্ষণ, ও টেকসই চাষাবাদ পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার অংশ।
প্রযুক্তির ব্যবহার:আধুনিক কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। ট্রাক্টর, সেচ ব্যবস্থা, ড্রোন, বীজ প্রযুক্তি, জৈব সার ও কৃষি অ্যাপ্লিকেশন কৃষিকে আরও উন্নত ও কার্যকর করেছে।
টেকসই কৃষির ধারণা: টেকসই কৃষি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে মাটি, পানি ও পরিবেশের ক্ষতি না করে দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন বজায় রাখা হয়। এটি জৈব চাষ, বীজ সংরক্ষণ, ও প্রাকৃতিক সার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেয়।
সামাজিক প্রভাব: গ্রামীণ জীবনে কৃষির প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এটি শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং ঐতিহ্য, উৎসব, সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধনের সঙ্গেও যুক্ত।
বাংলাদেশে কৃষি: বাংলাদেশের প্রায় ৬০% মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। ধান, পাট, গম, আখ, চা ও সবজি দেশের প্রধান কৃষিপণ্য। কৃষি বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি।
সংক্ষেপে বলা যায়, কৃষি হলো মানবজীবনের মেরুদণ্ড, যা শুধু খাদ্য নয়, সমাজ ও অর্থনীতির শক্ত ভিত্তি গঠন করে। টেকসই ও আধুনিক কৃষির মাধ্যমে একটি দেশ তার ভবিষ্যৎকে আরও সমৃদ্ধ ও নিরাপদ করতে পারে।