স্টয়কিওমেট্রি (Stoichiometry) কাকে বলে?

Avatar
calender 08-11-2025

স্টয়কিওমেট্রি (Stoichiometry) হলো রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পদার্থের ভর, মোল, অণু ও আয়নের মধ্যে পরিমাণগত সম্পর্ক নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বোঝা যায় একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কত পরিমাণ বিক্রিয়ক (reactant) দরকার এবং কত পরিমাণ উৎপন্ন পদার্থ (product) তৈরি হবে। স্টয়কিওমেট্রির মূল ধারণা হলো “ভর সংরক্ষণ সূত্র” (Law of Conservation of Mass), অর্থাৎ কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মোট ভর অপরিবর্তিত থাকে। এই নীতির ভিত্তিতেই প্রতিটি রাসায়নিক সমীকরণ সঠিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ (balanced) হতে হয়।

রসায়নে স্টয়কিওমেট্রি এত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বস্তুর পরিমাণ নির্ধারণ, বিক্রিয়ার ফলাফল পূর্বাভাস দেওয়া, এবং শিল্পকারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি জানা থাকে এক মোল মিথেন (CH₄) সম্পূর্ণ জ্বালাতে কত মোল অক্সিজেন (O₂) প্রয়োজন এবং কত মোল কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) উৎপন্ন হবে, তবে সেটিই স্টয়কিওমেট্রির সাহায্যে নির্ণয় করা যায়।

স্টয়কিওমেট্রির সংজ্ঞা:
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক ও উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে পরিমাণগত (quantitative) সম্পর্ক নির্ধারণের বিজ্ঞানকেই বলা হয় স্টয়কিওমেট্রি (Stoichiometry)

• এটি মূলত রাসায়নিক সমীকরণের ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে।
• “Stoichiometry” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ stoicheion (অর্থাৎ উপাদান) এবং metron (অর্থাৎ পরিমাপ) থেকে, যার মানে দাঁড়ায় “উপাদানের পরিমাপ”।
• এর মাধ্যমে জানা যায় কোনো বিক্রিয়ায় কত মোল বিক্রিয়ক ব্যবহার হলে কত মোল পণ্য তৈরি হবে।
• স্টয়কিওমেট্রির মূল ধারণা দাঁড়িয়ে আছে অভিক্রিয়ক ও উৎপন্ন পদার্থের অনুপাত নির্ণয়, ভর ও মোলের রূপান্তর, এবং গ্যাসীয় আয়তনের হিসাবের ওপর।

স্টয়কিওমেট্রির মূল ভিত্তি বা সূত্রসমূহ:
ভর সংরক্ষণ সূত্র (Law of Conservation of Mass): রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মোট ভর অপরিবর্তিত থাকে।
নির্দিষ্ট অনুপাত সূত্র (Law of Definite Proportion): প্রতিটি যৌগ সর্বদা নির্দিষ্ট অনুপাতে উপাদান দ্বারা গঠিত।
একাধিক অনুপাত সূত্র (Law of Multiple Proportion): যখন দুটি উপাদান একাধিক যৌগ গঠন করে, তখন তাদের ভর একটি নির্দিষ্ট পূর্ণসংখ্যা অনুপাতে থাকে।

উদাহরণ:
মিথেনের দহন বিক্রিয়া—
CH₄ + 2O₂ → CO₂ + 2H₂O

এই বিক্রিয়ায় দেখা যায়, ১ মোল মিথেন গ্যাস সম্পূর্ণ জ্বলতে ২ মোল অক্সিজেন লাগে এবং উৎপন্ন হয় ১ মোল কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ২ মোল পানি। অর্থাৎ, বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক ও উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মোল অনুপাত (1:2:1:2) বজায় থাকে—এটাই স্টয়কিওমেট্রির মূল ধারণা।

স্টয়কিওমেট্রির প্রয়োগ:
• রাসায়নিক সমীকরণ ভারসাম্যপূর্ণ করতে।
• বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিক্রিয়কের পরিমাণ নির্ধারণে।
• উৎপন্ন পদার্থের পরিমাণ পূর্বাভাসে।
• শিল্পকারখানায় কাঁচামালের পরিমাণ নির্ণয়ে।
• ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার নির্ভুলতা বৃদ্ধিতে।

স্টয়কিওমেট্রিক গণনার ধাপসমূহ:
• প্রথমে রাসায়নিক সমীকরণটি সঠিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ করতে হয়।
• তারপর প্রতিটি পদার্থের মোল অনুপাত নির্ধারণ করতে হয়।
• প্রদত্ত ভর বা আয়তনকে মোল-এ রূপান্তর করতে হয়।
• শেষে স্টয়কিওমেট্রিক অনুপাতে হিসাব করে অজানা পদার্থের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ হিসাব:
2H₂ + O₂ → 2H₂O
এখানে দেখা যাচ্ছে, ২ মোল হাইড্রোজেন গ্যাস সম্পূর্ণ জ্বালাতে ১ মোল অক্সিজেন লাগে এবং উৎপন্ন হয় ২ মোল পানি।
অর্থাৎ, ৪ গ্রাম হাইড্রোজেন (২ মোল) সম্পূর্ণ জ্বললে উৎপন্ন হবে ৩৬ গ্রাম পানি (২ মোল × ১৮ গ্রাম)।

স্টয়কিওমেট্রির প্রকারভেদ:

প্রকার বর্ণনা
ভরভিত্তিক স্টয়কিওমেট্রি ভরের ওপর ভিত্তি করে বিক্রিয়ক ও উৎপন্ন পদার্থের সম্পর্ক নির্ধারণ করে
মোলভিত্তিক স্টয়কিওমেট্রি মোল অনুপাতের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়
আয়তনভিত্তিক স্টয়কিওমেট্রি গ্যাসীয় পদার্থের আয়তন ব্যবহার করে সম্পর্ক নির্ণয় করে
সীমাবদ্ধ বিক্রিয়ক বিশ্লেষণ কোন বিক্রিয়ক আগে শেষ হবে ও উৎপন্ন পদার্থের পরিমাণ কত হবে তা নির্ণয় করে

স্টয়কিওমেট্রির গুরুত্ব:
• এটি রাসায়নিক বিক্রিয়াকে পরিমাণগতভাবে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে।
শিল্প ও গবেষণাগারে কাঁচামালের অপচয় রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
রাসায়নিক উৎপাদনের কার্যকারিতা ও অর্থনৈতিক দিক উন্নত করে।
• শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানীদের রসায়নের বাস্তব রূপ বোঝাতে সহায়তা করে।

স্টয়কিওমেট্রি (Stoichiometry) হলো এমন একটি মৌলিক রসায়ন ধারণা যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পদার্থের পরিমাণগত সম্পর্ক নির্ধারণে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। এটি কেবল তাত্ত্বিক নয়, বাস্তব জীবনের প্রয়োগেও গুরুত্বপূর্ণ—যেমন শিল্প উৎপাদন, গবেষণা, এবং পরীক্ষাগারে নির্ভুল পরিমাপ। সঠিক স্টয়কিওমেট্রিক জ্ঞান ছাড়া কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া সঠিকভাবে বিশ্লেষণ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তাই একে বলা হয় রসায়নের হৃদয় বা পরিমাপের বিজ্ঞান।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD