ATP কে জৈবমুদ্রা বলা হয় কেন?

Avatar
calender 07-11-2025

ATP (Adenosine Triphosphate) কে জৈবমুদ্রা বলা হয় কারণ এটি জীবদেহে শক্তি সঞ্চয় ও পরিবহনের প্রধান অণু হিসেবে কাজ করে। যেমন অর্থ মুদ্রা দিয়ে সমাজে সব লেনদেন সম্পন্ন হয়, তেমনি জীবদেহে সকল জৈব ক্রিয়ার জন্য ATP শক্তির “লেনদেনের মাধ্যম” হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোষের ভেতরে যে সকল রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, সেগুলোর বেশিরভাগই শক্তি নির্ভর। একদিকে যেমন কিছু বিক্রিয়া শক্তি উৎপন্ন করে, অন্যদিকে কিছু বিক্রিয়ায় শক্তি প্রয়োজন হয়। এই শক্তির উৎপাদন, সঞ্চয় ও ব্যবহার—সবকিছুই ATP-কে কেন্দ্র করে ঘটে। তাই একে জীববিজ্ঞানে বলা হয় “শক্তির একক” বা “জৈবমুদ্রা (Energy Currency)”

ATP অণুটি একটি অ্যাডেনিন (Adenine), একটি রাইবোজ (Ribose) এবং তিনটি ফসফেট (Phosphate) গ্রুপ নিয়ে গঠিত। এর তৃতীয় ফসফেট বন্ধনটি উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন, যা ভাঙলে প্রচুর শক্তি মুক্ত হয়। এই শক্তিই কোষের সব কাজের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ATP কে জৈবমুদ্রা বলা হওয়ার কারণগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—

  • শক্তি সঞ্চয় ও মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা:
    ATP যখন ভাঙে (ATP → ADP + Pi), তখন প্রায় ৭.৩ কিলোক্যালরি শক্তি মুক্ত হয়। এই শক্তিই কোষের বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন— পেশী সঙ্কোচন, স্নায়ু সংকেত পরিবহন, প্রোটিন সংশ্লেষণ, ও সক্রিয় পরিবহন। আবার কোষ যখন অতিরিক্ত শক্তি উৎপন্ন করে (যেমন শ্বসনের সময়), তখন ADP ও অজৈব ফসফেট মিলে নতুন ATP তৈরি হয়। ফলে এটি শক্তি সঞ্চয় ও ব্যবহার—উভয় প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু।

  • সকল জৈব ক্রিয়ার সাধারণ শক্তি মাধ্যম:
    জীবদেহে হাজারো রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, কিন্তু সবগুলোই এক ধরনের শক্তি ব্যবহার করে না। ATP হলো একমাত্র এমন অণু, যা প্রত্যেক জীবপ্রক্রিয়ায় ব্যবহারযোগ্য শক্তি সরবরাহ করে। যেমন, কার্বোহাইড্রেট ভাঙনের সময় উৎপন্ন শক্তি প্রথমে ATP-তে রূপান্তরিত হয়, তারপর অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়—যেমন কোষ বিভাজন বা প্রোটিন গঠন।

  • ATP-এর পুনঃচক্রায়ন ক্ষমতা:
    ATP ক্রমাগত উৎপন্ন ও ব্যবহৃত হয়। একটি কোষ দিনে প্রায় লক্ষাধিক বার ATP ভাঙে ও পুনর্গঠন করে। অর্থাৎ এটি অর্থনীতির টাকার মতো—ব্যবহার হয়, আবার পুনরায় তৈরি হয়। এই পুনরাবৃত্তি জীবদেহে শক্তির ধারাবাহিক সরবরাহ নিশ্চিত করে।

  • শক্তি স্থানান্তরের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম:
    ATP-এর উচ্চ-শক্তির ফসফেট বন্ধন সহজে ভাঙে, কিন্তু নিয়ন্ত্রিতভাবে। ফলে এটি শক্তি অপচয় না করে নির্দিষ্ট জৈব বিক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোষের অভ্যন্তরে অণু পরিবহন বা এনজাইম সক্রিয়করণে এই শক্তি ব্যবহার হয়।

  • অ্যানাবলিক ও ক্যাটাবলিক বিক্রিয়ায় সংযোগ স্থাপন:
    জীবদেহে ক্যাটাবলিক বিক্রিয়া (যেখানে জটিল অণু ভেঙে শক্তি উৎপন্ন হয়) এবং অ্যানাবলিক বিক্রিয়া (যেখানে নতুন জটিল অণু তৈরি হয়) পরস্পর নির্ভরশীল। ATP এই দুই প্রক্রিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। অর্থাৎ এক দিকের শক্তি উৎপাদনকে অন্য দিকের শক্তি ব্যবহারযোগ্য করে তোলে।

ATP-এর এই শক্তি ব্যবহারের প্রক্রিয়াগুলো নিচের টেবিল থেকে বোঝা যায়—

কার্যক্রম ATP-এর ভূমিকা উদাহরণ
পেশী সঙ্কোচন শক্তি সরবরাহ করে পেশীর ফাইবার সংকুচিত করে দৌড়ানো, হাঁটা
সক্রিয় পরিবহন (Active Transport) কোষঝিল্লি দিয়ে অণু পরিবহন করে সোডিয়াম-পটাসিয়াম পাম্প
জৈব সংশ্লেষণ প্রোটিন, লিপিড ও নিউক্লিক অ্যাসিড তৈরিতে শক্তি দেয় DNA ও RNA গঠন
স্নায়ু সংকেত পরিবহন নিউরনে আয়ন চলাচলের জন্য শক্তি দেয় স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া
তাপ উৎপাদন শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে শীতকালে বিপাকক্রিয়া বৃদ্ধি

ATP কে জৈবমুদ্রা বলার আরেকটি কারণ হলো এর সর্বজনীনতা। পৃথিবীর প্রতিটি জীব—মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া—সকলের কোষে ATP একইভাবে কাজ করে। অর্থাৎ, এটি একটি সর্বজনীন শক্তির মুদ্রা, যা জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য একীকরণ ঘটিয়েছে।

ATP-এর উৎপাদন হয় মূলত কোষশ্বসন (Cellular Respiration) প্রক্রিয়ায়—গ্লুকোজ অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ভেঙে কার্বন ডাই-অক্সাইড, পানি ও ATP উৎপন্ন করে। আবার উদ্ভিদের ক্ষেত্রে প্রকাশন ক্রিয়া (Photosynthesis)-তেও আলোর শক্তি ATP-তে রূপান্তরিত হয়। ফলে জীবদেহে শক্তির উৎস যেভাবেই হোক, তার চূড়ান্ত ব্যবহার ATP-এর মাধ্যমেই ঘটে।

ATP ছাড়া কোষের কোনো কার্যক্রম চলতে পারে না। এটি না থাকলে পেশী সঙ্কুচিত হবে না, এনজাইম কাজ করবে না, স্নায়ু সংকেত চলবে না—অর্থাৎ জীবদেহ স্থবির হয়ে পড়বে। তাই একে বলা হয় “Life’s Energy Currency” বা জীবনের শক্তির মুদ্রা।”


সবকিছু বিবেচনায় বলা যায়, ATP কে জৈবমুদ্রা বলা হয় কারণ এটি জীবদেহে শক্তি সঞ্চয়, পরিবহন ও ব্যবহারের প্রধান মাধ্যম। অর্থ যেমন সমাজে বিনিময়ের একক, তেমনি ATP জীবদেহে শক্তির বিনিময়ের একক। এর উচ্চ-শক্তি ফসফেট বন্ধন জীবনের প্রতিটি রাসায়নিক ক্রিয়াকে চালিত করে, আর এ কারণেই এটি জীববিজ্ঞানের অন্যতম অপরিহার্য ও সর্বজনীন অণু।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD