অবস্থান্তর মৌলসমূহ রঙিন যৌগ গঠন করে কেন?

Avatar
calender 07-11-2025

অবস্থান্তর মৌলসমূহ (Transition Elements) রঙিন যৌগ গঠন করে কারণ এদের d–কক্ষপথে (d-orbitals) আংশিক পূর্ণ ইলেকট্রন থাকে, যা আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে এবং বাকিটা প্রতিফলিত করে রঙ সৃষ্টি করে। এই বৈশিষ্ট্যই অবস্থান্তর মৌলসমূহকে অন্যান্য মৌল থেকে আলাদা করে তোলে। সাধারণভাবে, কোনো মৌলের যৌগ তখনই রঙিন হয় যখন তার পরমাণু বা আয়নের গঠনে এমন ইলেকট্রন থাকে যা আলোক শক্তি শোষণ করে উচ্চতর শক্তিস্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে। অবস্থান্তর মৌলসমূহের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত কার্যকরভাবে ঘটে কারণ তাদের d-ইলেকট্রন বিন্যাস অসম্পূর্ণ থাকে, ফলে ইলেকট্রন সহজেই এক শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে লাফিয়ে যেতে পারে এবং আলোর নির্দিষ্ট অংশ শোষণ করে। এর ফলেই যৌগে রঙ দেখা দেয়।

অবস্থান্তর মৌলসমূহের রঙিন যৌগ গঠনের কারণগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো—

  • আংশিক পূর্ণ d–কক্ষপথের উপস্থিতি:
    অবস্থান্তর মৌলসমূহের ইলেকট্রনিক বিন্যাসে d–কক্ষপথ আংশিকভাবে পূর্ণ থাকে (যেমন 3d¹–3d⁹ পর্যন্ত)। এই d–ইলেকট্রনগুলো শক্তিস্তরের মধ্যে উত্তরণ ঘটাতে পারে, যার ফলে তারা দৃশ্যমান আলোর নির্দিষ্ট অংশ শোষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, Cu²⁺ (d⁹) আয়ন নীল রঙের যৌগ তৈরি করে, কারণ এটি কম শক্তির লাল আলো শোষণ করে নীল আলো প্রতিফলিত করে।

  • d–d ইলেকট্রন উত্তরণ (d–d transition):
    অবস্থান্তর ধাতব আয়নের যৌগে যখন d–কক্ষপথের ইলেকট্রন আলোর শক্তি শোষণ করে এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে যায়, তখন তাকে d–d transition বলে। এই শোষিত আলোর পরিপূরক রঙ আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয়। যেমন— [Ti(H₂O)₆]³⁺ আয়ন বেগুনি রঙের, কারণ এটি সবুজাভ আলো শোষণ করে।

  • লিগ্যান্ড ক্ষেত্র প্রভাব (Crystal Field Effect):
    অবস্থান্তর মৌলের যৌগে লিগ্যান্ড (যেমন H₂O, NH₃, Cl⁻ ইত্যাদি) ধাতব আয়নের চারপাশে ঘিরে থাকে। এই লিগ্যান্ডগুলো d–কক্ষপথকে দুটি শক্তিস্তরে বিভক্ত করে। ফলে ইলেকট্রন নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তরে উত্তীর্ণ হয় আলোর শক্তি শোষণ করে। বিভিন্ন লিগ্যান্ড বিভিন্ন শক্তির বিভাজন ঘটায়, তাই রঙও ভিন্ন হয়। যেমন— [Cu(H₂O)₆]²⁺ নীল এবং [Cu(NH₃)₄]²⁺ বেগুনি রঙের।

  • অক্সিডেশন অবস্থার পরিবর্তন:
    একই মৌলের ভিন্ন অক্সিডেশন অবস্থায় ইলেকট্রনের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়, ফলে d–d transition ভিন্নভাবে ঘটে এবং যৌগের রঙও ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ,

    • Fe²⁺ (Ferrous) যৌগ সাধারণত হালকা সবুজ রঙের,

    • Fe³⁺ (Ferric) যৌগ হলুদ বা বাদামি রঙের।
      এই পার্থক্য ইলেকট্রন বিন্যাস ও শক্তি বিভাজনের কারণে ঘটে।

  • চার্জ ট্রান্সফার (Charge Transfer) প্রক্রিয়া:
    কখনও কখনও রঙের কারণ শুধু d–d transition নয়, বরং ইলেকট্রন স্থানান্তর। অর্থাৎ ইলেকট্রন ধাতব আয়ন ও লিগ্যান্ডের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়, যা দৃশ্যমান আলোর শক্তি শোষণ করে রঙ সৃষ্টি করে। যেমন— MnO₄⁻ (পারম্যাঙ্গানেট আয়ন) বেগুনি রঙের, যদিও এতে d–d transition তেমন নেই, কিন্তু O থেকে Mn-এর দিকে চার্জ স্থানান্তর ঘটে।

এখন নিচের টেবিল থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান্তর মৌল ও তাদের যৌগের রঙ দেখা যাক—

মৌল / আয়ন যৌগের উদাহরণ রঙ
Ti³⁺ [Ti(H₂O)₆]³⁺ বেগুনি
V²⁺ [V(H₂O)₆]²⁺ বেগুনি
Cr³⁺ [Cr(H₂O)₆]³⁺ সবুজ
Mn²⁺ MnCl₂ হালকা গোলাপি
Fe²⁺ FeSO₄ হালকা সবুজ
Fe³⁺ FeCl₃ বাদামি
Cu²⁺ CuSO₄·5H₂O নীল
Ni²⁺ Ni(NO₃)₂ সবুজ
Co²⁺ CoCl₂ গোলাপি (শুকনো অবস্থায় নীলচে)

এগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে অবস্থান্তর মৌলসমূহের রঙ একক নয়, বরং তাদের অক্সিডেশন অবস্থা, লিগ্যান্ডের ধরন ও d–ইলেকট্রনের সংখ্যা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।

অবস্থান্তর মৌলসমূহের এই রঙিন বৈশিষ্ট্যের ফলে এগুলো রঞ্জক, কাচ, সিরামিক, ফটোগ্রাফিক দ্রব্য, এবং রাসায়নিক নির্দেশক তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, Cr₂O₃ (Chromium oxide) সবুজ রঙের রঞ্জক, আর CoO (Cobalt oxide) নীল রঙের রঞ্জক হিসেবে কাচ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।


অতএব বলা যায়, অবস্থান্তর মৌলসমূহ রঙিন যৌগ গঠন করে মূলত তাদের d–কক্ষপথে আংশিক পূর্ণ ইলেকট্রনের উপস্থিতি এবং আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণের কারণে। d–d transition, লিগ্যান্ড ক্ষেত্র বিভাজন ও অক্সিডেশন অবস্থার ভিন্নতা এদের যৌগকে নানারঙে রূপান্তরিত করে। এই বৈশিষ্ট্য কেবল পদার্থবিজ্ঞানের এক চমৎকার ঘটনা নয়, বরং শিল্প ও গবেষণাক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ রসায়নীয় সম্পদ।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD