গতি কত প্রকার ও কী কী?
গতি মূলত তিন প্রকার— সরল গতি, বৃত্তাকার গতি ও দোলন গতি। কোনো বস্তুর অবস্থান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হলে তাকে গতি বলে, এবং সেই পরিবর্তনের ধরন অনুযায়ী গতিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানে গতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা কেবল বস্তু কীভাবে চলে তা-ই ব্যাখ্যা করে না, বরং সেই গতির প্রকৃতি, দিক, বেগ এবং ত্বরণ সম্পর্কেও ধারণা দেয়। যখন কোনো বস্তুর স্থান বা অবস্থান নির্দিষ্ট সময়ে পরিবর্তিত হয়, তখন বলা হয় বস্তুটি গতিশীল, আর যদি না হয়, তবে সেটি স্থির। গতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে উপস্থিত— যেমন নদীর প্রবাহ, পাখির ওড়া, গাড়ির চলা কিংবা ঘড়ির কাঁটার ঘোরা— সবই গতির প্রকাশ।
গতি বিভিন্নভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়, তবে বস্তু যেভাবে চলাচল করে তার ওপর ভিত্তি করে প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
-
সরল গতি (Linear Motion)
এটি এমন এক ধরনের গতি, যেখানে বস্তু সরল পথে চলে। যেমন— একটি ট্রেন রেললাইনে চলা বা একটি গাড়ি সোজা রাস্তা ধরে চলা। এখানে বস্তু একটি নির্দিষ্ট দিকেই চলে এবং তার পথটি সোজা থাকে। এই গতিতে দিক পরিবর্তন হয় না। সরল গতি আবার দুই প্রকার—-
সমবেগ সরল গতি: বস্তুর বেগ বা গতিবেগ সর্বদা সমান থাকে। উদাহরণ: একটি গাড়ি যদি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে সমানভাবে চলে।
-
অসমবেগ সরল গতি: বস্তুর বেগ সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণ: রাস্তায় যানজটে চলা গাড়ি কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত চলে।
-
-
বৃত্তাকার গতি (Circular Motion)
যখন কোনো বস্তু একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর চারদিকে সমান দূরত্ব বজায় রেখে ঘূর্ণন করে, তখন তাকে বৃত্তাকার গতি বলে। যেমন— ঘড়ির কাঁটা, ফ্যানের পাখা বা পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ। এখানে বস্তুর গতি বৃত্তাকার পথে ঘটে এবং তার দিক ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়, যদিও গতির মান একই থাকতে পারে। এই গতি অনেক সময় সমবেগ বা অসমবেগ উভয় ধরনের হতে পারে।-
সমবেগ বৃত্তাকার গতি: যখন বস্তু সমান বেগে বৃত্তপথে চলে।
-
অসমবেগ বৃত্তাকার গতি: যখন বস্তুর বেগ সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়।
-
-
দোলন গতি (Oscillatory Motion)
দোলন গতি এমন এক ধরনের গতি যেখানে বস্তু একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর চারপাশে সামনে-পেছনে পুনরাবৃত্তি করে চলে। যেমন— দোলনা, ঘড়ির দোলক বা টিউনিং ফর্কের দোলন। এই গতি নিয়মিত সময় অন্তর পুনরাবৃত্ত হয়। দোলন গতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি স্থিতিস্থাপক বলের কারণে ঘটে এবং নির্দিষ্ট পর্যায়ক্রমে পুনরাবৃত্ত হয়।
গতি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য নিচের টেবিলটি দেখা যাক—
| গতির ধরন | সংজ্ঞা | উদাহরণ |
|---|---|---|
| সরল গতি | বস্তু যখন সোজা পথে চলে | গাড়ির রাস্তা ধরে চলা |
| বৃত্তাকার গতি | বস্তু যখন বৃত্তাকার পথে চলে | ঘড়ির কাঁটা, ফ্যানের ঘূর্ণন |
| দোলন গতি | বস্তু নির্দিষ্ট বিন্দুর চারপাশে সামনে-পেছনে চলে | দোলনা, ঘড়ির দোলক |
এই তিনটি গতিই আবার আরও বিশদভাবে ভাগ করা যায় বস্তু কত দ্রুত, কীভাবে এবং কোন পথে চলাচল করছে তার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, সরল গতি যদি সমান সময়ের ব্যবধানে সমান দূরত্ব অতিক্রম করে, তবে তা সমবেগ গতি; আর যদি সময়ের সাথে দূরত্বের পার্থক্য দেখা যায়, তবে তা অসমবেগ গতি।
গতি বোঝাতে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানের পরিমাপকও ব্যবহার করি, যেমন— বেগ, ত্বরণ, দূরত্ব, স্থানান্তর ও সময়।
-
বেগ বলে বোঝায় কোনো বস্তু কত দ্রুত চলছে।
-
ত্বরণ নির্দেশ করে বেগের পরিবর্তনের হার।
-
স্থানান্তর হলো নির্দিষ্ট দিকের মোট পরিবর্তন।
গতি বিশ্লেষণের জন্য নিউটনের গতি সূত্রগুলো (Newton’s Laws of Motion) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সূত্রগুলো ব্যাখ্যা করে কীভাবে কোনো বস্তু স্থির থাকে, গতি শুরু করে বা গতির পরিবর্তন ঘটে। বিশেষত প্রথম সূত্র অনুযায়ী, কোনো বস্তুতে বাহ্যিক বল প্রয়োগ না হলে তা তার স্থিরাবস্থা বা সমবেগ গতিতে থেকে যায়।
পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার গতির মধ্যে কিছু গতি খুবই বিশেষ ভূমিকা রাখে— যেমন পৃথিবীর আবর্তন ও পরিক্রমণ গতি, যা দিন-রাত ও ঋতু পরিবর্তনের কারণ। আবার মাইক্রোস্কোপিক স্তরে অণু ও পরমাণুর গতিও একটি মৌলিক বৈজ্ঞানিক বিষয়, যা পদার্থের তাপ, শক্তি ও গঠন নির্ধারণ করে।
গতি শুধুমাত্র পদার্থবিজ্ঞানের বিষয় নয়, এটি প্রকৃতির এক অপরিহার্য নিয়ম। জীবন্ত প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে শুরু করে নদীর প্রবাহ বা গ্রহের পরিক্রমণ— সব ক্ষেত্রেই গতির প্রভাব দৃশ্যমান।
সুতরাং বলা যায়, গতি হলো কোনো বস্তুর অবস্থান সময়ের সাথে পরিবর্তন এবং এর প্রধান তিন রূপ— সরল, বৃত্তাকার ও দোলন গতি। প্রতিটি গতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য রয়েছে। গতি ছাড়া পৃথিবী ও মহাবিশ্বের কোনো প্রক্রিয়াই সম্ভব নয়, কারণ গতি-ই হলো প্রকৃতির চিরন্তন রূপ— যা সৃষ্টি, বিকাশ ও পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি।