শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। (ভাবসম্প্রসারণ করুন)

"শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড"
মূলভাব: শিক্ষা মানবজীবনের আলোকবর্তিকা, যা মানুষকে চিন্তা, বিবেক, মানবতা ও নৈতিকতার পথে পরিচালিত করে। শিক্ষা ছাড়া মানুষ যেমন অন্ধকারে ঘোরে, তেমনি জাতিও হয়ে পড়ে দুর্বল, পশ্চাৎপদ ও অগ্রগতিহীন। তাই বলা হয়— “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।” যেমন দেহের মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে মানুষ অচল হয়ে পড়ে, তেমনি শিক্ষা ছাড়া জাতিও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই একটি জাতিকে শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও সভ্য করে তুলতে পারে।
সম্প্রসারিত ভাব: শিক্ষা কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়, বরং এটি এমন এক শক্তি যা মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়, ভালো-মন্দ পার্থক্য করতে সাহায্য করে এবং সঠিক পথে চলার প্রেরণা জোগায়। শিক্ষা মানুষকে মুক্ত চিন্তার অধিকারী করে তোলে। একজন শিক্ষিত মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজ, দেশ ও মানবজাতির কল্যাণেও কাজ করে। শিক্ষিত নাগরিকই দেশের উন্নয়নের প্রকৃত কারিগর। তারা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি— প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয় এবং জাতিকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেয়। একটি জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে তার নাগরিকদের শিক্ষার ওপর। শিক্ষা মানুষকে আত্মনির্ভর করে তোলে, মেধা ও পরিশ্রমের মূল্য বোঝায়, দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে এবং সমাজে ন্যায়ের ভিত্তি স্থাপন করে। ইতিহাসের প্রতিটি উন্নত জাতির পেছনে রয়েছে শিক্ষার দৃঢ় ভিত। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা, রোমান সাম্রাজ্য, ইসলামী স্বর্ণযুগ কিংবা আধুনিক ইউরোপ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শিক্ষা ও জ্ঞানের বিস্তারই জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার গুরুত্ব আরও গভীর। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কৃতির বিকাশ— সব ক্ষেত্রেই শিক্ষিত মানুষের ভূমিকা ছিল অনন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “একটি জাতিকে গড়ে তুলতে হলে আগে তার মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে।” সত্যিই, শিক্ষাই মানুষের মনের দাসত্ব ভেঙে দেয়, তাকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেয়। শিক্ষা মানুষকে শুধু কর্মজীবনের উপযুক্ত করে না, বরং তাকে নৈতিক ও মানবিক করে তোলে। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষা করে, অন্যের অধিকারকে সম্মান করে এবং সমাজে ন্যায় ও শান্তির প্রতিষ্ঠা ঘটায়। শিক্ষার আলো মানুষকে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও অজ্ঞতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেয়। একজন নিরক্ষর মানুষ যেখানে সহজেই বিভ্রান্ত হয়, সেখানে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যুক্তি ও বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল ডিগ্রি অর্জন নয়; এটি চরিত্র গঠন, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা। বর্তমান সমাজে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও প্রতিযোগিতার ফলে অনেক সময় শিক্ষার আসল লক্ষ্য হারিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজন এমন শিক্ষা ব্যবস্থা, যা শুধু পেশা নয়, মানুষ তৈরির আদর্শ গড়ে তুলবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের শিক্ষাও দিতে হবে। একটি শিক্ষিত সমাজেই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। শিক্ষিত নাগরিক তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সতর্ক থাকে। তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সমাজে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে, অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী সহজেই প্রতারণার শিকার হয়, কুসংস্কারে ডুবে থাকে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে। একজন শিক্ষিত মানুষ নিজের অধিকার বুঝতে পারে, অন্যের অধিকারও সম্মান করে। সে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়। শিক্ষিত নারী যেমন পরিবারকে আলোকিত করে, তেমনি একটি প্রজন্মকেও গড়ে তোলে। তাই নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম— কারণ শিক্ষিত মায়ের হাতেই গড়ে ওঠে শিক্ষিত জাতি। একটি জাতির সাফল্য নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। যখন শিক্ষা সর্বজনীন হয়, তখন সমাজে দারিদ্র্য কমে, অপরাধ কমে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ে এবং জাতি হয় উন্নত। কিন্তু যেখানে অশিক্ষা বিরাজ করে, সেখানে অনাচার, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও কুসংস্কার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই জাতির উন্নয়নের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই।
মন্তব্য: সবশেষে বলা যায়, শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত সাফল্যের নয়, বরং জাতীয় অগ্রগতির প্রধান চাবিকাঠি। এটি জাতির অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার শক্তিশালী ভিত্তি। একটি জাতির উন্নয়ন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্ভর করে তার নাগরিকদের শিক্ষার মানের ওপর। তাই প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য শিক্ষার আলো নিজের জীবনে গ্রহণ করা এবং অন্যদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে দেওয়া। অতএব, শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে হবে, মানসম্মত করতে হবে এবং নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কারণ যে জাতি শিক্ষা অর্জনে যত বেশি মনোযোগী, সে জাতি তত দ্রুত অগ্রসর হয়। সত্যিই, “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”— এটি কোনো প্রবাদ নয়, এটি চিরন্তন সত্য।