রক্ষিতা কাকে বলে?
রক্ষিতা বলতে এমন এক নারীকে বোঝায়, যিনি কোনো পুরুষের আর্থিক, সামাজিক ও বস্তুগত আশ্রয়ে জীবনযাপন করেন, কিন্তু সেই পুরুষের সঙ্গে তার বৈধ বিবাহবন্ধন থাকে না। তিনি পুরুষটির পরিচর্যা, সঙ্গদান ও পারিবারিক জীবনের কিছু দিক পূরণ করেন, তবে আইনত বা ধর্মীয়ভাবে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃত নন। এই সম্পর্ক সাধারণত গোপন বা অপ্রকাশ্য থাকে এবং সমাজে পূর্ণ মর্যাদা লাভ করে না।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ:
“রক্ষিতা” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধাতু “রক্ষ” থেকে, যার অর্থ “রক্ষা করা” বা “যত্ন নেওয়া”। অর্থাৎ, যাকে কেউ রক্ষা বা লালনপালন করে, তাকে রক্ষিতা বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে রক্ষিতা প্রথা ছিল এক স্বীকৃত সামাজিক বাস্তবতা, যেখানে রাজা, জমিদার বা উচ্চবিত্ত পুরুষেরা স্ত্রী ছাড়াও কোনো প্রিয় নারীকে আশ্রয় দিতেন। সেই নারী অর্থ, গৃহ, অলংকার ও প্রভাব পেতেন, কিন্তু তার সামাজিক ও আইনি মর্যাদা হতো সীমিত।
রক্ষিতার বৈশিষ্ট্য:
-
রক্ষিতা সাধারণত কোনো পুরুষের আর্থিক সহায়তায় নির্ভরশীল থাকতেন।
-
সম্পর্কটি সামাজিকভাবে বৈধ বিবাহ নয়, বরং ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক।
-
তিনি পুরুষটির সংসারে স্ত্রী-সুলভ ভূমিকা পালন করলেও আইনি স্বীকৃতি পেতেন না।
-
সন্তান জন্ম নিলেও সমাজে তাদের বৈধ উত্তরাধিকার মর্যাদা দেওয়া হতো না।
-
রক্ষিতা নারীরা অনেক সময় সৌন্দর্য, সংগীত, নৃত্য বা সাহিত্যিক প্রতিভার কারণে প্রভাবশালী হতেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রক্ষিতা প্রথা:
প্রাচীন ভারতে রাজপরিবার ও অভিজাত সমাজে রক্ষিতা প্রথা ছিল প্রচলিত। রাজারা অনেক সময় রাজনৈতিক সম্পর্ক বা কূটনৈতিক কারণে অন্য পরিবারের নারীদের রক্ষিতা হিসেবে রাখতেন। সংস্কৃত সাহিত্য, মহাকাব্য ও পুরাণে “রক্ষিতা” শব্দের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন—
-
“মেঘদূত” বা “কামসূত্র”-এর মতো সাহিত্যে রক্ষিতা নারীদের অবস্থান ও জীবনের ইঙ্গিত রয়েছে।
-
রাজা হর্ষবর্ধন, সম্রাট অশোক প্রভৃতি শাসকের জীবনীতে রক্ষিতা নারীদের নাম পাওয়া যায়, যারা কখনো কখনো রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করতেন।
সামাজিক ও নৈতিক বিশ্লেষণ:
রক্ষিতা প্রথা একসময় সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিফলন ছিল। ধনী পুরুষেরা তাদের সম্পদ ও ক্ষমতার মাধ্যমে নারীর জীবনে কর্তৃত্ব স্থাপন করতেন। কিন্তু এই ব্যবস্থায় নারী তার স্বতন্ত্র মর্যাদা হারাতেন এবং কেবলমাত্র পুরুষের আনন্দ ও নির্ভরতার অংশ হিসেবে বিবেচিত হতেন।
আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ সমতা, মানবাধিকার ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশের ফলে রক্ষিতা প্রথা অবৈধ ও অনৈতিক হিসেবে গণ্য হয়।
বর্তমান আইনি ও সামাজিক অবস্থান:
বর্তমান আইনে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আইনত অপরাধ এবং সমাজে নিন্দনীয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে একত্রে বসবাস বা যৌন সম্পর্ককে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
তবে কিছু সমাজবিজ্ঞানী একে মানবসম্পর্কের সামাজিক বাস্তবতার অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে নারী অর্থনৈতিক কারণে বা সামাজিক চাপের ফলে এমন সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য হন।
রক্ষিতা প্রথার প্রভাব:
-
এটি নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে হ্রাস করে।
-
সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য ও নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে।
-
পরিবারের কাঠামো দুর্বল করে।
-
আইন, ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধিতা করে।
উপসংহার:
অতএব, রক্ষিতা হলো এমন এক নারী, যিনি কোনো পুরুষের আশ্রয়ে থেকে তার জীবনের অংশ হলেও আইনত স্ত্রী নন। ইতিহাসে এটি এক সামাজিক বাস্তবতা ছিল, কিন্তু আধুনিক সমাজে এটি নৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকেই অগ্রহণযোগ্য। রক্ষিতা প্রথা সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কের বৈষম্য ও নৈতিক ভারসাম্যহীনতার প্রতীক, যা বর্তমান সভ্য সমাজে স্থান পাওয়ার মতো নয়।