মাইটোকন্ড্রিয়াকে 'কোষের শক্তিধর' বলা হয় কেন?
মাইটোকন্ড্রিয়াকে ‘কোষের শক্তিধর’ বা Powerhouse of the Cell বলা হয়, কারণ এটি জীবন্ত কোষে শক্তি উৎপাদনের মূল অঙ্গাণু। প্রতিটি জীবিত কোষ তার কাজ সম্পাদনের জন্য শক্তি ব্যবহার করে, যেমন—চলাচল, বৃদ্ধি, কোষ বিভাজন, প্রোটিন তৈরি, শ্বাসক্রিয়া ইত্যাদি। এই শক্তিই উৎপন্ন হয় মাইটোকন্ড্রিয়ায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে, যেখানে গ্লুকোজ এবং অক্সিজেন থেকে ATP (Adenosine Triphosphate) নামক শক্তির অণু তৈরি হয়। এই ATP-ই কোষের সমস্ত কাজের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ও অবস্থান
মাইটোকন্ড্রিয়া প্রায় সব প্রাণীদেহের কোষে পাওয়া যায় এবং এর গঠন দ্বি-ঝিল্লিযুক্ত।
-
বহিঃঝিল্লি: এটি কোষের বাইরের অংশকে সুরক্ষা দেয়।
-
অভ্যন্তরীণ ঝিল্লি: এতে অসংখ্য ভাঁজ থাকে, যেগুলোকে ক্রিস্টি (Cristae) বলা হয়। এই স্থানে শক্তি উৎপাদনের এনজাইম থাকে।
-
ম্যাট্রিক্স (Matrix): এটি মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ তরল অংশ, যেখানে ক্রেবস চক্র (Krebs Cycle) পরিচালিত হয়।
শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া
মাইটোকন্ড্রিয়া খাদ্য থেকে পাওয়া গ্লুকোজকে ভেঙে শক্তিতে রূপান্তর করে, যাকে কোষশ্বাস (Cellular Respiration) বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তিনটি ধাপ ঘটে—
-
গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis): সাইটোপ্লাজমে ঘটে, যেখানে গ্লুকোজ ভেঙে পাইরুভিক অ্যাসিড তৈরি হয়।
-
ক্রেবস চক্র (Krebs Cycle): মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে ঘটে; এখানে পাইরুভিক অ্যাসিড ভেঙে ইলেকট্রন ও CO₂ উৎপন্ন হয়।
-
ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খল (Electron Transport Chain): এটি অভ্যন্তরীণ ঝিল্লিতে ঘটে এবং সর্বাধিক ATP উৎপন্ন করে।
এই তিন ধাপের মাধ্যমে উৎপন্ন ATP হলো কোষের “শক্তি মুদ্রা”। কোষের যে কোনো কাজ সম্পাদনে এই ATP প্রয়োজন হয়।
মাইটোকন্ড্রিয়াকে শক্তিধর বলার মূল কারণ
-
এটি কোষের সব ধরনের শক্তি সরবরাহ করে।
-
জীবদেহে মোট শক্তির ৯৫% পর্যন্ত ATP মাইটোকন্ড্রিয়ায় তৈরি হয়।
-
কোষের বৃদ্ধি, বিভাজন ও বিপাকীয় ক্রিয়ায় শক্তি সরবরাহ করে।
-
শক্তি উৎপাদন ছাড়া কোষ কার্যক্ষম থাকে না।
-
যেসব কোষে বেশি কাজ হয় (যেমন পেশি কোষ), সেখানে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা বেশি থাকে।
উদাহরণসহ বিশ্লেষণ
| কোষের ধরন | মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা | কারণ |
|---|---|---|
| পেশি কোষ | অনেক বেশি | বেশি শক্তি প্রয়োজন হয় চলাচলের জন্য |
| স্নায়ু কোষ | মাঝারি | বার্তা প্রেরণ ও সংকেত প্রক্রিয়ায় শক্তি লাগে |
| ত্বক কোষ | তুলনামূলক কম | কম কার্যকর কাজের জন্য কম শক্তি প্রয়োজন |
অতিরিক্ত তথ্য
মাইটোকন্ড্রিয়া শুধু শক্তি উৎপাদনেই নয়, বরং কোষের মৃত্যুনিয়ন্ত্রণ (Apoptosis), বিপাক নিয়ন্ত্রণ ও ক্যালসিয়াম সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখে। এটি নিজস্ব DNA বহন করে এবং স্বাধীনভাবে বিভাজন করতে পারে, যা প্রমাণ করে যে একসময় এটি স্বাধীন জীব ছিল এবং পরে কোষের অংশে পরিণত হয়েছে।
উপসংহার
অতএব, মাইটোকন্ড্রিয়াকে ‘কোষের শক্তিধর’ বলা হয়, কারণ এটি জীবদেহের সব শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্র। এর উৎপন্ন ATP ছাড়া কোষের কোনো কার্যক্রমই সম্ভব নয়। জীবনের প্রতিটি চলন, বিপাক ও ক্রিয়াশীলতার পেছনে মাইটোকন্ড্রিয়াই হলো প্রকৃত শক্তির উৎস।