জবাবদিহিতা বলতে কি বুঝায়?
জবাবদিহিতা এমন একটি ধারণা যা সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করে। এটি এমন এক নীতি যেখানে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারের যেকোনো অংশ তাদের কার্যক্রম, সিদ্ধান্ত ও ফলাফলের জন্য দায়বদ্ধ থাকে। জবাবদিহিতা মূলত গণতন্ত্র ও সুশাসনের অন্যতম ভিত্তি, যা জনগণের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে জবাবদিহিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো—
মূল ধারণা: জবাবদিহিতা বলতে বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকার তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত ও ফলাফলের জন্য অন্যের কাছে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য থাকে। এটি এক ধরনের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়া যা সমাজে ন্যায়, শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে।
জবাবদিহিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য:
• দায়বদ্ধতা: ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করতে হয় এবং সেই কাজের ফলাফল ব্যাখ্যা করতে হয়।
• স্বচ্ছতা: কাজের প্রক্রিয়া জনগণের কাছে স্পষ্ট ও উন্মুক্ত থাকতে হবে যাতে কোনো গোপনীয়তা বা দুর্নীতি না থাকে।
• অন্যের কাছে জবাবদানের বাধ্যবাধকতা: কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের কর্মফল নিয়ে উচ্চতর কর্তৃপক্ষ বা জনগণের কাছে জবাব দিতে বাধ্য।
• শাস্তি ও পুরস্কার ব্যবস্থা: কেউ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে শাস্তি এবং সফল হলে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
• জনঅংশগ্রহণ: জনগণ যাতে প্রশাসনের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত থাকতে পারে ও প্রশ্ন করতে পারে, সেই সুযোগ নিশ্চিত করা হয়।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা:
• সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য জবাবদিহিতা অপরিহার্য। যেমন—বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ একে অপরের প্রতি জবাবদিহি থাকে।
• নির্বাহী বিভাগকে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় কারণ সংসদই জনগণের প্রতিনিধি।
• আইন বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখতে হয় যাতে তারা নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের বৈধতা যাচাই করতে পারে।
• সরকারের বাজেট, নীতি বা প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা:
• সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারি, সমবায় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তাদের অংশীদার বা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
• কোনো প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের সেবা প্রদান করে, তবে তার কাজের মান ও ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কে জনসমক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে।
সুশাসনের সাথে সম্পর্ক:
• জবাবদিহিতা হলো সুশাসনের অন্যতম স্তম্ভ। যেখানে জবাবদিহিতা নেই, সেখানে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।
• জবাবদিহিতার মাধ্যমে সরকার ও প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা বাড়ে, যা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশে জবাবদিহিতা বাস্তবায়ন:
• বাংলাদেশে প্রশাসনিক, বিচারিক ও আইন প্রণয়নকারী সংস্থার মধ্যে জবাবদিহিতা বজায় রাখতে সংবিধান বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
• দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক দপ্তর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কাজ করে।
• নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও তথ্য অধিকার আইনও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতায় সহায়ক ভূমিকা রাখে।
গুরুত্ব ও উপসংহার: জবাবদিহিতা শুধু রাষ্ট্র বা সরকারের বিষয় নয়, এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রযোজ্য। পরিবার থেকে শুরু করে বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও জবাবদিহিতা ন্যায়, শৃঙ্খলা ও উন্নতির পথ প্রশস্ত করে। যে সমাজে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং উন্নয়ন হয় টেকসই ও স্বচ্ছভাবে।
সুতরাং, জবাবদিহিতা হলো এমন এক নীতি যা শাসনব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং ন্যায়নিষ্ঠ করে তোলে।