রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে কেন বিজ্ঞান বলা হয়?
 
                        রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হয় কারণ এটি রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি ও নাগরিক জীবনের বিষয়গুলোকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিশ্লেষণ করে এবং বাস্তব তথ্য, অভিজ্ঞতা ও যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। বিজ্ঞান বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি এমন একটি জ্ঞানব্যবস্থা যা পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, পরীক্ষা ও প্রমাণের মাধ্যমে সত্য অনুসন্ধান করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানও একইভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাগুলোর কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব ও নীতি প্রণয়ন করে। এই কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শুধু একটি চিন্তাশাস্ত্র নয়, বরং একটি বিজ্ঞান বলা হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক হওয়ার মূল কারণ হলো এর গবেষণাপদ্ধতি ও বিশ্লেষণভিত্তিক কাঠামো। এটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা না গেলেও সমাজে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ ও তুলনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করে। যেমন—গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বা সামরিক শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক চরিত্র প্রকাশ করে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ
রাষ্ট্রবিজ্ঞান নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ধাপ অনুসরণ করে, যেমন—
- 
পর্যবেক্ষণ: রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও শাসনব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে তা পর্যবেক্ষণ করা। 
- 
তথ্যসংগ্রহ: নির্বাচনী ব্যবস্থা, জনমত, প্রশাসনিক কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। 
- 
বিশ্লেষণ: সংগৃহীত তথ্য যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে কারণ ও ফল নির্ণয় করা। 
- 
উপসংহার: বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাধারণ নীতি বা তত্ত্ব তৈরি করা। 
 এই ধাপগুলোই প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গবেষণাভিত্তিক শাস্ত্র যা নির্ভর করে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির ওপর।
কারণ ও ফল সম্পর্ক বিশ্লেষণ
বিজ্ঞানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কারণ-ফল সম্পর্ক নির্ণয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানও একইভাবে অনুসন্ধান করে কেন একটি রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে বা কেন বিপ্লব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্লেষণ করে কী কারণে ফরাসি বিপ্লব ঘটেছিল বা কেন গণতন্ত্র কিছু দেশে টেকে আর কিছু দেশে ব্যর্থ হয়। এই বিশ্লেষণ একেবারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়।
সাধারণ নীতি ও তত্ত্ব প্রণয়ন
যে কোনো বিজ্ঞান তার পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণ নীতি তৈরি করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানও রাজনৈতিক আচরণ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু সার্বজনীন নীতি গঠন করেছে, যেমন—
- 
ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্ব (Theory of Separation of Powers) 
- 
সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব (Theory of Sovereignty) 
- 
সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব (Social Contract Theory) 
- 
গণতন্ত্রের নীতি ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ তত্ত্ব 
 এসব নীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক কাঠামো তৈরি করে এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
তথ্য ও প্রমাণনির্ভর গবেষণা
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান এখন সম্পূর্ণ তথ্যনির্ভর (data-driven)। নির্বাচনের ফলাফল, জনমত জরিপ, অর্থনৈতিক সূচক ও প্রশাসনিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন—কোনো দেশের ভোটের আচরণ পরিবর্তন হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তা বিশ্লেষণ করেন সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক তথ্যের ভিত্তিতে, যা বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণের মতোই কার্যকর।
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস দেওয়ার সক্ষমতা
একটি বিজ্ঞান ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নির্ধারণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দেশে দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে গণঅসন্তোষ বা সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনুমান করতে পারে।
অন্যান্য বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস ও আইনশাস্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যেমন—অর্থনীতি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে, ইতিহাস অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করে, আর আইন রাষ্ট্রের কাঠামো নির্ধারণ করে। এই আন্তঃবিষয়ক সম্পর্ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আরও বাস্তবভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক করেছে।
উপসংহার
রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হয় কারণ এটি রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতির ঘটনাগুলোকে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রমাণনির্ভরভাবে ব্যাখ্যা করে। এটি কোনো অনুমান বা মতবাদ নয়, বরং একটি নিয়মতান্ত্রিক ও যৌক্তিক জ্ঞানের শাখা। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমন একটি সমাজবিজ্ঞান যা মানব সমাজের রাজনৈতিক জীবনকে বুঝতে এবং উন্নয়ন ঘটাতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করে। এই কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে যথার্থভাবে “বিজ্ঞান” বলা হয়, এবং এটি আধুনিক সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।