ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে বানিজ্যিক বিস্তার ঘটায়?

Avatar
calender 30-10-2025

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বানিজ্যিক বিস্তার ঘটিয়েছিল সুপরিকল্পিত কূটনীতি, সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে। ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ প্রথম কোম্পানিটিকে পূর্বদেশে ব্যবসা করার একচেটিয়া অনুমতি দেন। এর ফলে তারা প্রথমে শুধুমাত্র বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতে আসে, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলে।

বিস্তারিতভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বানিজ্যিক বিস্তারের ধাপগুলো নিচে তুলে ধরা হলো—

প্রাথমিক বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ (১৬০০–১৭০৭):
প্রথমে কোম্পানির লক্ষ্য ছিল মসলা, সিল্ক, কাপড়, চা ও রেশমজাত দ্রব্য বাণিজ্য করা।
তারা ১৬১৩ সালে সুরাটে প্রথম কারখানা স্থাপন করে, যা ভারতের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সূচনা।
পরবর্তীতে মাদ্রাজ (১৬৩৯), বোম্বে (১৬৬৮) ও কলকাতা (১৬৯০)-তে তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করে তারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অধিকার পায়, যা তাদের বাণিজ্যিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে।

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সামরিক বিস্তার (১৭০৭–১৭৬৫):
মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে কোম্পানি তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতে থাকে।
১৭৫৭ সালের প্লাসির যুদ্ধ ছিল তাদের বাণিজ্যিক আধিপত্যের মোড় ঘোরানো ঘটনা। এই যুদ্ধে তারা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলার শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ নেয়।
১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধ-এর মাধ্যমে তারা মোগল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয়ের কাছ থেকে দেওয়ানি অধিকার লাভ করে, ফলে তারা বাংলার রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে নেয়।

 রাজস্বনীতি ও অর্থনৈতিক শোষণ:
তারা জমিদার ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কর আদায় শুরু করে এবং ইংরেজ শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ করে ইউরোপে পাঠায়।
বাংলার কাপড় ও হস্তশিল্প শিল্প ধ্বংস করে তারা ইংল্যান্ডের কারখানার পণ্যের বাজার তৈরি করে।
এইভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ শিল্পব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে ইংরেজ পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়।

 বানিজ্যিক একচেটিয়াকরণ:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে অন্যান্য ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের (পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি) পরাজিত করে ভারতের বাণিজ্যের একচেটিয়া মালিক হয়ে ওঠে।
তারা চা, আফিম, লবণ, সুতার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বিশাল মুনাফা অর্জন করে।
চীনের সঙ্গে আফিম ব্যবসার মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করে।

 প্রশাসনিক ও আইনগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা:
কোম্পানি শুধুমাত্র বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং নিজস্ব আদালত, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলে।
১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট ও ১৭৮৪ সালের পিটস ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনে, কিন্তু কোম্পানির প্রভাব অটুট থাকে।

ফলাফল ও প্রভাব:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক বিস্তার ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারানোর প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
তারা অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে ভারতকে কাঁচামালের উৎস ও ইংরেজ পণ্যের বাজারে পরিণত করে।
এই প্রক্রিয়াই পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এবং শেষে ব্রিটিশ শাসনের সূচনার পথ তৈরি করে।

সুতরাং, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বানিজ্যিক বিস্তার ছিল পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কৌশলের ফল। তারা প্রথমে বাণিজ্যের অজুহাতে ভারতে প্রবেশ করে, পরে রাজনীতি, যুদ্ধ ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো উপমহাদেশের অর্থনৈতিক সম্পদ নিজেদের হাতে নেয় এবং ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করে।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD