আলোর প্রতিসরণ এমন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সর্বত্র দেখা যায়—আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখা থেকে শুরু করে পানিতে পড়া বস্তুর বিকৃত চিত্র পর্যন্ত। এটি মূলত এমন এক ভৌত প্রক্রিয়া, যেখানে আলোর রশ্মি কোনো প্রতিবন্ধক বা প্রতিবিম্বিত পৃষ্ঠে আঘাত করলে দিক পরিবর্তন করে ফিরে আসে। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে প্রতিসরণ আমাদের চোখে দেখা প্রায় প্রতিটি দৃশ্যের সাথে জড়িত।

প্রধান তথ্যাবলি নিচে তুলে ধরা হলো:

• সংজ্ঞা: আলোর প্রতিসরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে আলোর রশ্মি কোনো প্রতিবন্ধক বা পৃষ্ঠে আঘাত করলে সেটি ফিরে আসে একই মাধ্যমের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, আয়নায় নিজের মুখ দেখা মানে আলোর প্রতিসরণ ঘটছে।

• প্রতিসরণের ইংরেজি পরিভাষা: প্রতিসরণকে ইংরেজিতে Reflection of Light বলা হয়। এখানে “Reflection” অর্থ প্রতিফলন বা ফিরে আসা, যা আলোর আঘাতের পর ঘটে।

• কীভাবে ঘটে: যখন আলোর রশ্মি একটি পৃষ্ঠে আঘাত করে, সেই পৃষ্ঠ যদি মসৃণ ও উজ্জ্বল হয় (যেমন আয়না), তবে রশ্মি দিক পরিবর্তন করে ফিরে আসে। এ প্রক্রিয়াকেই প্রতিসরণ বলে।

• প্রতিসরণের দুটি প্রধান ধরন:
  সমতল প্রতিসরণ: এটি ঘটে যখন আলো একটি সমতল ও মসৃণ পৃষ্ঠে (যেমন সমতল আয়না) প্রতিফলিত হয়। এতে আলোর প্রতিফলনের দিক সুনির্দিষ্ট হয়, এবং স্পষ্ট চিত্র তৈরি হয়।
  বক্র প্রতিসরণ: এটি ঘটে যখন আলো কোনো বক্র পৃষ্ঠে (যেমন অবতল বা উত্তল আয়না) প্রতিফলিত হয়। এতে প্রতিফলিত রশ্মিগুলি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে, এবং চিত্র বড় বা ছোট দেখা যায়।

• প্রতিসরণের মূল দুটি নিয়ম:
  প্রথম নিয়ম: প্রতিসরণের কোণ ও আপতন কোণ সমান হয়। অর্থাৎ, আলোর রশ্মি যত কোণে পৃষ্ঠে আঘাত করে, একই কোণে সেটি ফিরে আসে।
  দ্বিতীয় নিয়ম: আপতিত রশ্মি, প্রতিফলিত রশ্মি এবং লম্ব রেখা একই সমতলে থাকে। এটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম, যা প্রতিটি প্রতিসরণ প্রক্রিয়ায় প্রযোজ্য।

• প্রতিসরণের বাস্তব উদাহরণ:

  • আয়নায় নিজের মুখ দেখা।

  • স্থির জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা।

  • চকচকে মেঝেতে বা ধাতব পৃষ্ঠে আলোর প্রতিফলন।

  • গাড়ির হেডলাইটের আলো রাস্তায় ফিরে আসা।

• বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা: পদার্থবিজ্ঞানে প্রতিসরণকে তরঙ্গের দিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়। এটি কেবল আলোতেই নয়, শব্দ তরঙ্গ বা জল তরঙ্গেও ঘটে। অর্থাৎ, প্রতিসরণ হলো তরঙ্গের ফিরে আসা, যখন তা কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।

• প্রতিসরণ ও প্রতিসরণ (Refraction) এর পার্থক্য:
  অনেকেই “Reflection” ও “Refraction” শব্দদুটিকে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু পার্থক্য হলো—Reflection মানে ফিরে আসা (প্রতিসরণ) এবং Refraction মানে মাধ্যম পরিবর্তনের ফলে বাঁকা হওয়া। উদাহরণস্বরূপ, আয়নায় চিত্র দেখা হলো প্রতিসরণ; আর পানিতে ডুবানো পেন্সিল বাঁকা দেখা যাওয়া হলো প্রতিসরণ।

• প্রতিসরণের গুরুত্ব:

  • এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তি ও চিত্র দেখার মৌলিক প্রক্রিয়া।

  • ফটোগ্রাফি, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপসহ অপটিক্যাল যন্ত্র তৈরিতে প্রতিসরণের নিয়ম অপরিহার্য।

  • প্রতিফলক, আয়না ও ক্যামেরা লেন্সের গঠনেও এটি ব্যবহৃত হয়।

• সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়:
  প্রতিসরণ হলো সেই প্রক্রিয়া, যেখানে আলোর রশ্মি কোনো পৃষ্ঠে আঘাত করলে ফিরে আসে। এটি প্রকৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা দৃষ্টিশক্তি, প্রযুক্তি ও দৈনন্দিন জীবনের বহু দিককে প্রভাবিত করে।

এইভাবেই “আলোর প্রতিসরণ” আমাদের জীবনে দৃশ্যমান প্রতিটি আলোকচিত্রের ভিত্তি তৈরি করে—চাই সেটা আয়নার সামনে নিজের মুখ দেখা হোক বা দূরের কোনো উজ্জ্বল বস্তু পর্যবেক্ষণ করা হোক।