জুলাই বিপ্লব ২০২৪ রচনা

জুলাই বিপ্লব ২০২৪ কী
“জুলাই বিপ্লব ২০২৪” হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের নাম, যা মূলত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়ে দ্রুতই গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এটি শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে, তবে অল্প সময়ের মধ্যেই এটি কেবল কোটা ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং শিক্ষা, চাকরি, নারী-পুরুষ সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে রূপ নেয়।
প্রেক্ষাপট
যেকোনো বড় আন্দোলনের মতো জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এরও একটি দীর্ঘ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আন্দোলনটি হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি; বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষ ও বৈষম্যের ফলেই এর জন্ম। নিচে মূল প্রেক্ষাপটগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—
২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ উক্ত ২০১৮ সালের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই রায়ের পরপরই আন্দোলনের নতুন সূত্রপাত ঘটে। শিক্ষার্থীরা মনে করে—বছরের পর বছর ধরে তাদের ন্যায্য অধিকারকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহু বছর ধরে আলোচিত একটি বিষয়। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকার একটি পরিপত্র জারি করে, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাকরি সংরক্ষিত থাকে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে শহর-গ্রাম বৈষম্য, ধনী-গরিব বৈষম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্য বিরাজমান। চাকরি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিবর্তে কোটা-নির্ভর নিয়োগ অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে অন্যায় মনে হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যই শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের আগুনকে আরও জ্বালিয়ে তোলে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন একটি বিশেষ শক্তি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবগুলোতেই শিক্ষার্থীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরা যখন আবার রাস্তায় নামে, তখন আন্দোলন দ্রুত সার্বজনীন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠে।
তৎকালীন সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় জনগণের একটি অংশের মধ্যে শাসনব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ সুযোগ কাজে লাগায় এবং সরাসরি না হলেও আন্দোলনকে নানাভাবে সমর্থন করে। এর ফলে একটি অরাজনৈতিক দাবির আন্দোলন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।
গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের তরুণদের কোটা সংস্কার দাবিটি আলোচিত হতে থাকে। বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরাও এ আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। ফলে এটি আর শুধু অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত আন্দোলনে পরিণত হয়।
সব মিলিয়ে এই প্রেক্ষাপটগুলোই জুলাই বিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করে দেয়। দীর্ঘদিনের বৈষম্য, আদালতের রায়, শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মিলেই ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।
জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এর সময় কাল
জুলাই বিপ্লব ২০২৪ মূলত প্রায় দুই মাসব্যাপী এক উত্তাল রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের ধারাবাহিক রূপ, যার বিস্ফোরণ ঘটে জুলাই মাসে। যদিও আন্দোলনের বীজ রোপিত হয় ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে, তবে তা চূড়ান্ত রূপ নেয় জুলাই মাস জুড়ে এবং পরিণতি ঘটে ৫ আগস্ট ২০২৪-এ সরকারের পতনের মাধ্যমে। নিচে এর সময়কাল ধাপে ধাপে তুলে ধরা হলো—
-
৫ জুন ২০২৪: হাইকোর্ট ২০১৮ সালের কোটা সংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে।
-
রায়ের পরদিন থেকেই শিক্ষার্থীরা ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ শুরু করে।
-
আন্দোলন তখনও শান্তিপূর্ণ ছিল, দাবি ছিল কেবল ন্যায়সংগত কোটা সংস্কার।
-
আন্দোলন ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশালসহ বিভাগীয় শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
-
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কলেজ শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়।
-
আন্দোলনের মূল দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় বৈষম্যবিরোধী স্লোগান।
-
জুলাইয়ের শুরু থেকেই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
-
ঢাকায় বড় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
-
অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করা হয়। সরকারি অফিস, ক্লাস, পরিবহন—সবকিছুতে প্রভাব পড়ে।
-
সরকার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে।
-
ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে তথ্য প্রবাহে বড় বাধা তৈরি হয়।
-
নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
-
প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সংঘর্ষ, মিছিল, গ্রেপ্তার ও শহীদের ঘটনা ঘটে।
-
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আন্দোলন দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
-
৫ আগস্ট ২০২৪: ঢাকায় লাখো মানুষের সমাবেশে আন্দোলন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
-
সেনা ও পুলিশের বড় অংশ নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়।
-
শেষ পর্যন্ত সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং আন্দোলনকারীরা বিজয় ঘোষণা করে।
সংক্ষেপে বলা যায়—
-
সূচনা: ৫ জুন ২০২৪
-
বিস্ফোরণ: জুলাই মাসব্যাপী
-
সমাপ্তি: ৫ আগস্ট ২০২৪
জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এর ঘটনা প্রবাহ বিস্তারিত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এটি ছিল এমন এক আন্দোলন যা শুরুতে সীমিত পরিসরে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে সারা দেশের গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে সূচিত এ আন্দোলনের বিস্তৃতি, তীব্রতা এবং চূড়ান্ত পরিণতি—সব মিলিয়ে এটিকে এক অভিনব গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেয়।
প্রথম ধাপে, ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট কর্তৃক ২০১৮ সালের কোটা সংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা এ রায়ের পরই রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও মিছিল শুরু করে। এ সময় আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, স্লোগান ছিল ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার দাবিতে।
পরবর্তী পর্যায়ে আন্দোলনের পরিধি বাড়তে থাকে। জুনের শেষের দিকে এ আন্দোলন ঢাকা ছাড়িয়ে বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, সাধারণ মানুষ, শিক্ষক-অভিভাবক, শ্রমজীবী মানুষও এতে সংহতি প্রকাশ করে। আন্দোলনকারীরা তখন শুধু কোটা নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে। ফলে এটি বৈষম্যবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়।
জুলাই মাসে প্রবেশ করতেই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। রাজধানী ঢাকা পরিণত হয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ রাস্তায় নামতে থাকে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বহু মানুষ আহত হয়, অনেকে প্রাণ হারায়। তখনই আন্দোলনকারীরা অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করে। সরকারি অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে, পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে যায়। দেশের স্বাভাবিক প্রশাসনিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
পরবর্তী ধাপে সরকার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবুও আন্দোলন থামানো যায়নি। নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহিণী, তরুণী—সবাই আন্দোলনের মিছিলে যুক্ত হয়। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার এবং শহীদের ঘটনা ঘটতে থাকে।