হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরিচয় দাও

Avatar
calender 14-05-2025

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিশিষ্ট বাঙালি রাজনীতিবিদ, যিনি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব রেখেছেন। তিনি ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম স্যার জাহেদ সোহরাওয়ার্দী এবং মায়ের নাম খুরশিদ বেগম। পিতামাতার শিক্ষা ও সংস্কৃতি তাঁকে মানবিক, উদার এবং আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।


শিক্ষাজীবন: সোহরাওয়ার্দী কলকাতার নামকরা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেন এবং ব্যারিস্টারি লাভ করেন। এই ইংরেজি শিক্ষা তাঁকে আন্তর্জাতিক মানসিকতা, যুক্তিভিত্তিক চিন্তা এবং স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করে।


রাজনৈতিক জীবন এবং অগ্রযাত্রা: প্রাথমিকত তিনি পেশাগত জীবনে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করলেও, পরবর্তীতে সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯২১ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন। তখন দেশজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল এবং বাঙালিরা বিভিন্নভাবে ব্রিটিশ বিরোধের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ধরেছিল। সোহরাওয়ার্দীও সেখানকার দৃঢ় অংশীদার হয়ে উঠেন।


স্বদেশী আন্দোলন এবং প্রাদেশিক রাজনীতি: কলকাতা পৌরসভার কমিশনার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে জনগণের নিকট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মুসলিম লীগের হয়ে তিনি বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেন। তিনি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের পক্ষে কথা বলতে ছাড় দেননি। ১৯৪৬ সালে তিনি যুক্তফ্রন্ট ক্যাবিনেটের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখেন।


দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ ও কলকাতা কিলিংস: ১৯৪৬ সালের আগস্টে কলকাতায় ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ‘কলকাতা কিলিংস’-এর সময় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দী বিতর্কিত অবস্থানের কারণে সমালোচিত হন। অনেকে মনে করেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট ছিল না। যদিও তিনি অবশ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ ও প্রশাসনিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন।


বাংলা ভাগ: স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধী এবং ঐক্যবদ্ধ বাংলার পক্ষপাতী। তিনি চেয়েছিলেন যে, বাংলা অঞ্চল বিভক্ত না হয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আবর্তিত হোক। তাঁর ঐক্যবদ্ধ বাংলা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হলেও, তিনি বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।


পাকিস্তান পর্ব: ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) গঠনে শামিল হন এবং দলীয় রাজনীতি শুরু করেন। পাকিস্থানের রাজনীতি তখন পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক এবং পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার প্রায় উপেক্ষিত ছিল। সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারে অংশ নেন এবং যুক্তফ্রন্ট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।


যুক্তফ্রন্ট এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন: ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫৬ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি, যিনি সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর শাসনামলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও তার সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ও সামরিক চক্রান্তের মাধ্যমে পতিত হয়। তাঁর প্রধান মন্ত্রিত্বে তিনি পাকিস্তানে পঞ্চাশের দশকে নবজাগরণের বীজ বপন করেন।


জীবনের শেষ পর্ব: শাসনক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাঁকে আটক ও বন্দি করে রাখে। পরে তিনি স্বদেশেও জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রতীক হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। জীবনের শেষদিকে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর যথেষ্ট রহস্যজনক পরিস্থিতিতে বৈরুতের এক হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকের মতে, তাঁর মৃত্যুতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।


ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ: সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অসাধারণ কর্মঠ এবং বলিষ্ঠ ভাষণকারী। তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং বাঙালিয়ানাতে সমৃদ্ধ। জনগণের অধিকারকেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিয়েছেন, ছিলেন নিখাদ দেশপ্রেমিক। তাঁর অসামান্য নেতৃত্বতুল্যগুণ এবং আপসহীন স্বভাব তাঁকে এক অনন্য মহিমার আসনে বসিয়েছে।


 উত্তরাধিকার:বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অনুপম শিষ্য ছিলেন এবং সোহরাওয়ার্দীর নীতি ও আদর্শ থেকেই সচেতন রাজনীতিক হিসেবে গড়ে ওঠেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে সোহরাওয়ার্দীর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর রাজনৈতিক জীবন অনুপ্রেরণার নিদর্শন হয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসে।


হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপসহীন নেতা, গণতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থক, মানবতাবাদী চিন্তাবিদ এবং বিদগ্ধ বাঙালি দেশপ্রেমিক। উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনি রাষ্ট্রনীতির অন্যতম মুখ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন, আদর্শ ও অবদান জাতির জন্য যুগে যুগে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

Links

Home

Exams

Live Exam

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD