বৃষ্টি কবিতা
বৃষ্টি
ফররুখ আহমদ
বৃষ্টি এলো ... বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টি ! – পদ্মা মেঘনার
দুপাশে আবাদি গ্রামে, বৃষ্টি এলো পূবের হাওয়ায়,
বিদগ্ধ আকাশ, মাঠ ঢেকে গেল কাজল ছায়ায়;
বিদ্যুৎ-রূপসী পরী মেঘে মেঘে হয়েছে সওয়ার।
দিকদিগন্তের পথে অপরূপ আভা দেখে তার
বর্ষণ-মুখর দিনে অরণ্যের কেয়া শিহরায়,
রৌদ্র-দগ্ধ ধানক্ষেত আজ তার স্পর্শ পেতে চায়,
নদীর ফাটলে বন্যা আনে পূর্ণ প্রাণের জোয়ার।
রুণ বৃদ্ধ ভিখারির রগ-ওঠা হাতের মতন
রুক্ষ মাঠ আসমান শোনে সেই বর্ষণের সুর,
তৃষিত বনের সাথে জেগে ওঠে তৃষাতপ্ত মন,
পাড়ি দিয়ে যেতে চায় বহু পথ, প্রান্তর বন্ধুর,
যেখানে বিস্তৃত দিন পড়ে আছে নিঃসঙ্গ নির্জন
সেখানে বর্ষার মেঘ জাগে আজ বিষণ্ন মেদুর ॥
কবি পরিচিতি: ফররুখ আহমদ (১৯১৮–১৯৭৪) বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা কবি, যিনি “মুসলিম জাগরণের কবি” হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর কবিতায় ধর্মীয় অনুভূতি, মানবতাবাদ, সামাজিক চেতনা ও প্রকৃতিপ্রেম একসূত্রে গাঁথা। তিনি ইসলামী সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনাকে সাহিত্যিক ভাষায় প্রকাশ করে বাংলা কবিতাকে নতুন দিশা দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘সিঁড়ি তলায়’, ‘হাতেমতাই’, ‘নৌকাভাঙা’, এবং ‘ধূমকেতু’। সহজ শব্দচয়ন, গীতল ছন্দ ও চিত্রকল্পের সমৃদ্ধ ব্যবহার তাঁকে বাংলা কবিতার ভুবনে এক অমর স্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কবিতার মূলভাব: এই কবিতায় প্রকৃতির রূপ, জীবন ও বৃষ্টির পুনর্জীবনী শক্তি একত্রে ফুটে উঠেছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বৃষ্টি এসে শুধু জমিকে সজীব করে না, মানুষের অন্তরেও এনে দেয় নবজাগরণের সঞ্চার। কবি বৃষ্টির সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে জীবনের তৃষ্ণা, প্রকৃতির আবেগ এবং আশার বার্তা তুলে ধরেছেন।
মূল তথ্যসমূহ:
-
কবিতার শুরুতেই কবি “বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টি” বলে এক আনন্দঘন মুহূর্তের সৃষ্টি করেন। দীর্ঘ খরার পর বৃষ্টি যেন তৃষ্ণার্ত প্রকৃতির পরম তৃপ্তি।
-
পদ্মা-মেঘনা নদীর দুই পাড়ের গ্রাম বৃষ্টির আগমনে জীবন্ত হয়ে ওঠে, মাঠ-ঘাট ঢেকে যায় কালো মেঘে; যেন প্রকৃতির রূপসী পরী আকাশ জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।
-
বিদ্যুৎ-রূপসী পরী–এর উপমায় কবি বৃষ্টির আগমনের সৌন্দর্যকে কল্পনাময়ভাবে প্রকাশ করেছেন। এতে বোঝা যায়, প্রকৃতির প্রতিটি দৃশ্য কবির চোখে এক এক রমণীয় রূপে ধরা দেয়।
-
ধানক্ষেত, নদী ও অরণ্য–সবই বৃষ্টির স্পর্শে পুনর্জীবিত হয়। রৌদ্রে দগ্ধ ধান যেমন বাঁচার আশা পায়, তেমনি মানুষের মনও সিক্ত হয় বৃষ্টির পরশে।
-
কবি এক জায়গায় বৃদ্ধ ভিখারির রগ-ওঠা হাতের উপমা দিয়ে রুক্ষ মাঠের নিঃস্ব অবস্থাকে চিত্রিত করেছেন, যা বৃষ্টির সুরে প্রাণ ফিরে পায়।
-
বৃষ্টির সঙ্গেই তৃষ্ণার্ত মনের জাগরণ কবিতার গভীরতম অংশ। এখানে কবি শুধু প্রকৃতির পরিবর্তন নয়, মানুষের অন্তরজগতের পরিবর্তনকেও প্রতিফলিত করেছেন।
-
শেষের দিকে কবি বলেন, নিঃসঙ্গ প্রান্তরে যখন বর্ষার মেঘ ঘনায়, তখন এক ধরনের বিষণ্ন মেদুরতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটি মানুষের মনের আবেগময় দিকের প্রতিচ্ছবি।
সারাংশ: ‘বৃষ্টি’ কবিতায় ফররুখ আহমদ প্রকৃতির প্রাণবন্ত চিত্রের মাধ্যমে মানুষের জীবনে আশার আলো ও নবজীবনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। বৃষ্টি এখানে শুধু জল নয়, বরং এক আত্মিক মুক্তি ও সৃষ্টির পুনরারম্ভের প্রতীক। তাঁর কাব্যভাষা ও প্রতীক ব্যবহারের দক্ষতা কবিতাটিকে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের স্তরে উন্নীত করেছে।
মূল ভাবসংক্ষেপ: বৃষ্টি কবিতায় প্রকৃতি, মানুষ ও জীবনের বন্ধন ফুটে উঠেছে নবজীবনের সুরে। বৃষ্টি যেমন মাটিকে সজীব করে, তেমনি মানুষের মনেও আনে পুনর্জাগরণের অনন্ত আশা।