ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করো।

Avatar
calender 17-11-2025

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি মূলত বাঙালির ভাষাগত অধিকার, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার প্রতি যে অবহেলা ও বৈষম্য দেখায়, তা পূর্ববাংলার মানুষের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই অসন্তোষ ধীরে ধীরে সংগঠিত প্রতিবাদে রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ভাষা সংকটের শুরু
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে দুই অংশের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও সামাজিক চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মনে করত রাষ্ট্রভাষা শুধু উর্দুই হওয়া উচিত। কিন্তু পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫৬ শতাংশই ছিল বাংলাভাষী, তাই এই সিদ্ধান্ত পূর্ববাংলার জনগণের কাছে অযৌক্তিক মনে হয়।

উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাব
১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইনসভায় মুহম্মদ আলী জিন্নাহ এবং পরে খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এতে বাংলাকে অবজ্ঞা করা হয় এবং পূর্ববাংলার মানুষের মাঝে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়। ছাত্রসমাজ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত প্রতিবাদের শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের প্রতিক্রিয়া
১৯৪৮ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তমদ্দুন মজলিশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ভাষা আন্দোলনের চিন্তা, দাবিনামা ও দিকনির্দেশনা তৈরি করে। এতে আন্দোলন একটি সংগঠিত রূপ পায়।

বাংলাকে প্রশাসনিক ও উচ্চশিক্ষার ভাষা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা
সরকারি দপ্তর, আদালত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উর্দুকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। বাংলা ভাষাকে প্রান্তিক করে রাখার এই প্রচেষ্টা সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৫২ সালের প্রেক্ষাপট ও ১৪৪ ধারা জারি
১৯৫২ সালে সরকার আবারও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এর প্রতিবাদে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ও আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ভাষার দাবিতে ছাত্ররা সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিবাদে অংশ নেয়।

২১ ফেব্রুয়ারির গুলি এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ
২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ছাত্ররা মিছিল করলে পুলিশ গুলি চালায়, শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও আরও অনেকে। এই ঘটনা পুরো জাতিকে আন্দোলনের পথে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। ভাষা আন্দোলন এরপর আর শুধু ভাষার দাবি ছিল না; এটি বাঙালির জাতীয় অভ্যুদয়ের সূচনা হয়ে ওঠে।

আন্দোলনের সফলতা ও পরিণতি
অবশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় পরিচয়, আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তি স্থাপন করে। এই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাও জোগায়।

উৎস: বাংলাদেশ ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহ, সরকারি প্রকাশনা, ভাষা আন্দোলন গবেষণা প্রবন্ধ।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD