মাটি কাকে বলে?
মাটি পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উপাদান। এটি শুধু গাছপালা জন্মানোর মাধ্যমই নয়, বরং জলধারণ, পুষ্টি সরবরাহ, অণুজীবের বাসস্থান এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখে। বহু বছরের শিলা ক্ষয়, আবহাওয়ার প্রভাব এবং জীবজ উপাদানের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে যে উপযোগী স্তর তৈরি হয়, তাকেই আমরা মাটি বলে থাকি। গঠনে জটিল হলেও মাটির কাজ খুবই বাস্তবমুখী এবং মানবজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
• মাটির সংজ্ঞায় দেখা যায় যে এটি মূলত তিন ধরনের উপাদানের সমন্বয়: খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ এবং জীবন্ত অণুজীব। এই তিন উপাদান মিলেই মাটিকে উর্বর এবং উদ্ভিদ জন্মানোর উপযোগী করে তোলে।
• খনিজ পদার্থ মূলত শিলার ক্ষয় থেকে উৎপন্ন হয়। বৃষ্টির পানি, তাপমাত্রা পরিবর্তন এবং বাতাস শিলাকে ক্ষয় করে ছোট ছোট কণায় পরিণত করে। এর মাধ্যমেই বেলে, দোআঁশ বা কাদামাটির মতো বিভিন্ন ধরনের মাটি তৈরি হয়, যাদের গঠনভেদে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
• জৈব পদার্থ হলো মৃত গাছপালা, পাতা, প্রাণীর অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি পচে-গলে তৈরি হওয়া উপাদান। এ ধরনের পদার্থকে হিউমাস বলা হয় এবং এটি মাটিকে অত্যন্ত উর্বর করে। হিউমাস মাটির রং গাঢ় করে এবং পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়।
• মাটির ভেতরে নানা ধরনের অণুজীব থাকে, যেমন ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, শৈবাল ইত্যাদি। এসব জীব মাটির পচন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং খনিজ উপাদান গাছের শিকড়ের জন্য সহজলভ্য করে তোলে। অণুজীব না থাকলে মাটি কখনোই উর্বর হতে পারত না।
• মাটি তৈরি হতে হাজার হাজার বছর সময় লাগে। শিলা ক্ষয়ের গতি খুব ধীর হওয়ায় একটি পাতলা মাটি স্তর গঠনে অনেক সময় প্রয়োজন হয়। তাই মাটি প্রকৃতির এক মূল্যবান সম্পদ।
• মাটি গাছপালার জন্য পুষ্টির ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়ামসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান মাটির মধ্যেই থাকে এবং উদ্ভিদ শিকড়ের মাধ্যমে সেগুলো গ্রহণ করে।
• মাটি পানি শোষণ করে ধরে রাখে, ফলে বন্যা ও ক্ষয় কমে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনরায় পূরণ হয়। প্রকৃতির জলচক্র বজায় রাখতে মাটির এই ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
• বাংলাদেশে প্রধানত তিন ধরনের মাটি দেখতে পাওয়া যায়: পলিমাটি, টেরাই মাটি এবং পাহাড়ি মাটি। পলিমাটি সবচেয়ে উর্বর, কারণ নদী বয়ে আনা দোআঁশ উপাদানে এটি গঠিত।
• কৃষিকাজে মাটির ধরন অনুযায়ী চাষের ধরণ নির্ধারণ করা হয়। যেমন—বেলে মাটি সবজি চাষের জন্য ভালো, আর কাদামাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী।
• মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে জৈবসার, কম্পোস্ট ও সবুজ সার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশও রক্ষা পায়।
• অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, বন উজাড়, অতিরিক্ত চাষাবাদ ও পানি ক্ষয় মাটিকে নষ্ট করে, যাকে মাটির অবক্ষয় বলা হয়। এ সমস্যা রোধে বিজ্ঞানসম্মত কৃষি পদ্ধতি অত্যন্ত প্রয়োজন।
এভাবে দেখা যায়, খনিজ ও জৈব উপাদানের দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তরের মাধ্যমে তৈরি হওয়া যে মিশ্র মাধ্যম উদ্ভিদের জীবনধারণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তাকেই মাটি বলা হয়। এটি শুধু কৃষিকাজকেই সম্ভব করে না, বরং পৃথিবীর সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য।