হরমোন কাকে বলে? কত প্রকার ও কী কী? কোথায় উৎপন্ন হয় এবং তাদের কাজসমূহ কী কী?
হরমোন হলো দেহের ভেতরে থাকা বিশেষ রাসায়নিক বার্তাবাহক, যা খুব অল্প পরিমাণে রক্তের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছে তাদের কাজ নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করে। হরমোনের সাহায্যে দেহের বৃদ্ধি, বিকাশ, বিপাকক্রিয়া, প্রজনন, আবেগ, জল ও লবণের ভারসাম্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
হরমোন কাকে বলে?
-
হরমোন হলো অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত জৈব রাসায়নিক পদার্থ।
-
এরা রক্তের মাধ্যমে শরীরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে গিয়ে নির্দিষ্ট অঙ্গ বা কোষে কাজ করে।
-
হরমোনের কাজ সাধারণত হয় দেহের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করা; যেমন বৃদ্ধি, রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা, দুধ সৃষ্টি, যৌন বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি।
সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা:
যে সকল রাসায়নিক পদার্থ অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়ে রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে গিয়ে তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করে, তাদের হরমোন বলে।
হরমোনের প্রকারভেদ
প্রাত্যহিক পাঠ্যক্রম অনুযায়ী সাধারণভাবে দুইভাবে বোঝানো যায়—
-
(ক) প্রাণী/মানব হরমোন – মানবদেহের বিভিন্ন অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি যেমন পিটুইটারি, থাইরয়েড, প্যানক্রিয়াস, অ্যাড্রিনাল, গোনাড ইত্যাদি থেকে নিঃসৃত হরমোন।
-
(খ) উদ্ভিদ হরমোন – যেমন অক্সিন, জিব্বেরেলিন, সাইটোকাইনিন, ইথিলিন, অ্যাবসিসিক অ্যাসিড, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও দিকনির্দেশ নিয়ন্ত্রণ করে।
এখানে মূলত মানবদেহের প্রধান হরমোনগুলো ও তাদের উৎস ও কাজ সংক্ষেপে বলা হলো।
মানবদেহে প্রধান হরমোন, উৎস ও কাজ
পিটুইটারি গ্রন্থি (মস্তিষ্কের নিচে)
-
একে বলা হয় Master gland; কারণ এটি অন্য অনেক গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
-
প্রধান হরমোন:
-
Growth hormone (GH)
-
উৎপত্তিস্থল: পিটুইটারি সামনের অংশ।
-
কাজ: দেহের বৃদ্ধি ও হাড়ের লম্বা হওয়া, প্রোটিন সংশ্লেষ, সামগ্রিক শারীরিক বিকাশে সাহায্য করে।
-
-
TSH (Thyroid Stimulating Hormone)
-
কাজ: থাইরয়েড গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে থাইরোক্সিন নিঃসরণ বাড়ায়।
-
-
FSH, LH
-
কাজ: স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের ডিম্বাশয় ও অণ্ডকোষের কার্যকলাপ, ডিম্বস্ফোটন, শুক্রাণু উৎপাদন, যৌন হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ।
-
-
Prolactin
-
কাজ: প্রসূতা মায়ের স্তনে দুধ উৎপাদন উদ্দীপিত করে।
-
-
থাইরয়েড গ্রন্থি (গলার সামনের দিকে)
-
প্রধান হরমোন: থাইরক্সিন (Thyroxine)
-
উৎপত্তিস্থল: থাইরয়েড গ্রন্থি।
-
কাজ: দেহের বিপাকক্রিয়া (Metabolism) নিয়ন্ত্রণ করে; শক্তি উৎপাদন, বৃদ্ধি, স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজ, দেহের তাপমাত্রা ইত্যাদিতে ভূমিকা রাখে।
-
প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি
-
প্রধান হরমোন: Parathyroid hormone (PTH)
-
কাজ: রক্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ভারসাম্য রক্ষা; হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা।
-
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি (কিডনির উপরে)
-
প্রধান হরমোন:
-
Adrenaline (Epinephrine)
-
কাজ: ভয়, উত্তেজনা, বিপদের সময় হার্টবিট বাড়ানো, শ্বাস দ্রুত করা, রক্তচাপ বাড়ানো, পেশিতে বেশি রক্ত পাঠানো – অর্থাৎ “Fight or flight” প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি।
-
-
Cortisol
-
কাজ: দীর্ঘমেয়াদী স্ট্রেস মোকাবিলা, বিপাক নিয়ন্ত্রণ, প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
-
-
অগ্ন্যাশয় (Pancreas) – Langerhans দ্বীপ
-
প্রধান হরমোন:
-
Insulin
-
উৎপত্তিস্থল: বিটা কোষ।
-
কাজ: রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা কমানো, কোষে গ্লুকোজ প্রবেশে সাহায্য করা, অতিরিক্ত গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেন হিসেবে সঞ্চয় করা।
-
-
Glucagon
-
উৎপত্তিস্থল: আলফা কোষ।
-
কাজ: প্রয়োজনে রক্তে গ্লুকোজ বাড়ানো, লিভারের গ্লাইকোজেনকে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত করা।
-
-
গোনাড (প্রজনন গ্রন্থি)
-
ডিম্বাশয় (Ovary) – নারী
-
হরমোন: ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন
-
কাজ: নারীর দ্বিতীয়ক যৌন বৈশিষ্ট্য (শরীরের গঠন, স্তন বিকাশ ইত্যাদি), মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ, গর্ভধারণের প্রস্তুতি ইত্যাদি।
-
-
অণ্ডকোষ (Testis) – পুরুষ
-
হরমোন: টেস্টোস্টেরন
-
কাজ: পুরুষের দ্বিতীয়ক যৌন বৈশিষ্ট্য (গভীর কণ্ঠস্বর, দাড়ি-গোঁফ, পেশিবহুল শরীর ইত্যাদি), শুক্রাণু উৎপাদন, যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ।
-
উদ্ভিদ হরমোন
-
অক্সিন (Auxin) – কান্ডের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, আলোর দিকে বাঁকানো (Phototropism), শিকড়ের গঠন।
-
জিব্বেরেলিন (Gibberellin) – কান্ডের অস্বাভাবিক লম্বা হওয়া, বীজ অঙ্কুরোদগমে সাহায্য।
-
সাইটোকাইনিন (Cytokinin) – কোষ বিভাজন, কুঁড়ির বৃদ্ধি।
-
ইথিলিন (Ethylene) – ফল পাকানো, পাতা ঝরে পড়া।
-
অ্যাবসিসিক অ্যাসিড (ABA) – বিশ্রাম অবস্থায় যাওয়া, জলাভাবের সময় রন্ধ্র বন্ধ করা, প্রতিরক্ষা ভূমিকা।
সব মিলিয়ে, হরমোন হলো দেহের ভিতরের রাসায়নিক বার্তাবাহক, যা খুব অল্প পরিমাণে কাজ করেও দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কোষের কার্যকলাপ নিয়মিত ও সমন্বিত রাখে। বিভিন্ন অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন ধরনের হরমোন তৈরি হয় এবং এদের নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে—কোথাও বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, কোথাও শক্তি ব্যবহার, কোথাও প্রজনন, আবার কোথাও আবেগ ও চাপ নিয়ন্ত্রণ। তাই মানবদেহ ও উদ্ভিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও ভারসাম্য রক্ষায় হরমোনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।