কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি বলা হয় কেন?

Avatar
calender 15-11-2025

কাজী নজরুল ইসলামকে কেন বিদ্রোহী কবি বলা হয় তা বোঝার জন্য তাঁর সাহিত্যকর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির গভীরে তাকাতে হয়। তিনি ছিলেন এমন এক কবি, যিনি কেবল শব্দে নয়—চেতনায়, মননে এবং নৈতিক অবস্থানে বিদ্রোহী। তাঁর রচনায় স্বাধীনতার ডাক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কণ্ঠ এবং মানবমুক্তির অগ্নিশিখা সর্বদা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। তাই সাহিত্যসমালোচক, পাঠক এবং গবেষকরা একবাক্যে স্বীকার করেন যে নজরুল বাংলা সাহিত্যের অনন্য বিদ্রোহী কবি। নিচে তাঁর বিদ্রোহী পরিচয়ের মূল কারণগুলো সুসংগঠিতভাবে তুলে ধরা হলো।

  • ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শক্তিশালী উচ্চারণ: ১৯২২ সালে রচিত তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতা বাংলা সাহিত্যের বিপ্লবধর্মী কাব্যরূপকে নতুনভাবে পরিচিত করে। এখানে তিনি নিজেকে “বিদ্রোহী রণক্লান্ত,” “চির উন্নত শির,” “ঝঞ্ঝার ঝাপটা” ইত্যাদি রূপকে তুলে ধরে মানবমুক্তির সংগ্রামী শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেন। এই কবিতাই তাঁকে প্রথমবারের মতো বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত করে।

  • ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা: নজরুল ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচক। তাঁর কবিতা, গান ও প্রবন্ধে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার ডাক স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। “কারার ঐ লৌহ কপাট” ও “ভাঙার গান”–এর মতো সৃষ্টিতে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের দুর্বার আহ্বান তাঁকে পরাধীন বাংলার প্রতীকী কণ্ঠে পরিণত করে।

  • সামাজিক অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ: নজরুল সমাজের ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, জাতিভেদ, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধারালো লেখনী ব্যবহার করেছেন। তিনি নিপীড়িত কৃষক-শ্রমিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্রোহী সত্তাকে আরও শক্তিশালী করে।

  • ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে অবস্থান: নজরুল ছিলেন ধর্মীয় সাম্যের প্রবক্তা। তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের বিরুদ্ধে লিখেছেন এবং “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম” পঙ্‌ক্তিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গভীর আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিভাজন ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান বিদ্রোহী ভাবনাকে বৈশ্বিক মানবতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

  • নারী-পুরুষের সমতার দাবি: নজরুল নারীর অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার পক্ষে অত্যন্ত প্রখর কণ্ঠে লিখেছেন। “নারী” কবিতায় তিনি নারীকে “জগতের জননী,” “অর্ধাংশিনী” হিসেবে বর্ণনা করে সমাজে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই অবস্থানও তাঁর বিদ্রোহী চেতনার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।

  • অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন মনোভাব: নজরুল কখনোই ক্ষমতা, শাসক বা কর্তৃত্বের ভয় করেননি। তিনি সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার পক্ষে আপসহীন ছিলেন। তাঁর লেখনীতে প্রতিফলিত এই সাহসী অবস্থান তাঁকে এক অনন্য বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে বিদ্রোহ কেবল রাজনৈতিক নয়—মানবিক, সামাজিক, নৈতিক ও দার্শনিক পর্যায়েও বিস্তৃত। স্বাধীনতা, ন্যায়, সমতা ও মানবমুক্তির প্রশ্নে তাঁর নির্ভীক কণ্ঠ তাঁকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে অমর করে রেখেছে।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD