ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল?

Avatar
calender 14-11-2025

ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির অস্তিত্ববোধ, সাংস্কৃতিক অধিকার ও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাকে অবমূল্যায়ন করে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখনই শুরু হয় প্রতিবাদ, দাবি এবং সাংগঠনিক আন্দোলন। সময়ের ধারাবাহিকতায় এই আন্দোলন একদিকে যেমন জাতীয় চেতনার ভিত্তি গড়ে দেয়, অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের পথও আরও সুগম করে তোলে।

  • পাকিস্তানের জনগণের ৫৬%–এর মাতৃভাষা ছিল বাংলা, অথচ রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রশ্নে তাদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়। বাংলা ছিল পূর্ব বাংলার সভ্যতা, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনের ভাষা, তাই এটিকে অস্বীকার করাকে বাঙালিরা নিজেদের পরিচয়ের ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছিল।

  • নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল বেশি। এই পরিকল্পনা ছিল অগণতান্ত্রিক, একপেশে এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকারকারী।

  • ১৯৪৭ সালেই ভাষা প্রশ্নে অসন্তোষ শুরু হয়, কারণ দেশভাগের পরপরই কেন্দ্রীয় নেতারা স্পষ্টভাবে জানাতে শুরু করেন যে উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।

  • বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ মনে করতেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করলে প্রশাসন, শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা ও সরকারি কাজে জনগণের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে। মাতৃভাষার মর্যাদা নষ্ট হলে একটি জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়—এই উপলব্ধিই আন্দোলনকে আরও জোরদার করে।

  • উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টিও প্রকটভাবে সামনে আসে। বাঙালিরা বুঝতে পারে যে ভাষার প্রশ্ন আসলে তাদের অধিকার, সম্মান এবং রাষ্ট্রে সমান অংশীদারিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত।

  • পাকিস্তানের সরকার ১৯৪৮ সালে ঘোষণা দেয় যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রথম বড় প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। ফলে বাংলা ভাষার দাবিতে বিভিন্ন সমাবেশ, বিক্ষোভ ও সংগঠন তৈরি হতে শুরু করে।

  • আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আসে চূড়ান্ত রূপ, যখন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলেও শিক্ষার্থীরা তা অমান্য করে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল বের করেন। পুলিশ গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ কয়েকজন শহীদ হন। এই রক্তদান বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।

  • এই আন্দোলন শুধু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার সংগ্রাম ছিল না, বরং পরবর্তী সময়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার আন্দোলনের বীজ রোপণ করে। বাংলা হয়ে ওঠে জাতীয় ঐক্য, অধিকারবোধ এবং জাতিসত্তার প্রতীক।

  • পরে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়—যা ছিল আন্দোলনের বড় অর্জন।

  • ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত তাৎপর্য হলো—মাতৃভাষার জন্য জীবনদান বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী ভাষার মর্যাদা ও বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিন।

এইসব কারণেই মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাঙালিরা যে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল, সেটিই ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত।

© LXMCQ, Inc. - All Rights Reserved

Developed by WiztecBD