বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম কী এবং কোথায় অবস্থিত?
বাংলাদেশের ভূগোল যতটা সমতল বলে পরিচিত, ততটাই আশ্চর্যজনক হলো এর পার্বত্য সৌন্দর্য। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত তাজিংডং পাহাড় — যা সরকারি স্বীকৃতিতে দেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, ইতিহাসে সমৃদ্ধ এবং পর্যটনের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি স্থান।
তাজিংডং পাহাড় কোথায় অবস্থিত
তাজিংডং পাহাড় বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত। এই পাহাড়টি চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত, যা মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি। বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে এবং রুমা বাজার থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এই পাহাড়ের অবস্থান।
তাজিংডং নামের উৎপত্তি ও অর্থ
“তাজিংডং” শব্দটি এসেছে স্থানীয় বম ভাষা থেকে, যেখানে “তাজিং” মানে উঁচু এবং “ডং” মানে পাহাড়। অর্থাৎ তাজিংডং শব্দের মানে দাঁড়ায় “উঁচু পাহাড়ের রাজা”। স্থানীয় জনগণ একে “বিজয় পাহাড়” নামেও ডাকে, যা বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
উচ্চতা ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
সরকারি হিসেবে তাজিংডং পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ১,২৮০ মিটার (৪,২০০ ফুট)। এটি ঘন বন, ঝরনা, গিরিখাত ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। পাহাড়ের চারপাশে বম, মারমা, ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসবাস, যারা প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। এ পাহাড়ে উঠে আপনি মেঘের রাজ্যে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা পাবেন, যা বাংলাদেশের অন্য কোথাও বিরল।
তাজিংডং পৌঁছানোর উপায়
তাজিংডং ভ্রমণ একটি রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা।
-
প্রথমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বান্দরবান শহরে যেতে হয়।
-
সেখান থেকে জিপ বা চাঁদের গাড়ি করে রুমা বাজারে পৌঁছানো যায়।
-
রুমা থেকে গাইডসহ পায়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠতে হয়, যা সাধারণত ১০–১২ ঘণ্টার পথ।
-
ভ্রমণের জন্য বান্দরবান জেলা প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।
এ যাত্রাপথে “বগা লেক”, “কেওক্রাডং” ও “দার্জিলিং পাহাড়”সহ অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
তাজিংডং না কেওক্রাডং — বিতর্কের ইতিহাস
অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
-
কিছু গবেষক বলেন কেওক্রাডং (Keokradong), যার উচ্চতা প্রায় ১,২৩১ মিটার, আসলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
-
আবার অনেকে দাবি করেন সাকা হাফং (Saka Haphong), যা থাইংখালির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত, সেটিই প্রকৃত সর্বোচ্চ পাহাড়।
তবে সরকারি তথ্যসূত্র অনুযায়ী, তাজিংডংকেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (GSB) এবং Banglapedia উভয়ই তাজিংডংকেই “Government-recognized highest peak of Bangladesh” হিসেবে উল্লেখ করেছে।
পর্যটন ও প্রাকৃতিক আকর্ষণ
তাজিংডং শুধু একটি পাহাড় নয়, এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বিস্ময়।
-
পাহাড়ের ঢালে প্রচুর ঝরনা, বাঁশবন, ফলের গাছ ও নানা বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
-
স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে।
-
প্রতি বছর স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকরা এখানে ট্রেকিং, ক্যাম্পিং এবং নেচার ফটোগ্রাফির জন্য ভ্রমণ করে থাকেন।
বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন সম্প্রতি পাহাড়ি এলাকায় টেকসই পর্যটন বিকাশে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যাতে পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একসাথে সম্ভব হয়।
তাজিংডং পাহাড়ের পরিবেশগত গুরুত্ব
তাজিংডং পাহাড় বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, পাখি, বনজ প্রাণী ও ভেষজ উদ্ভিদ দেখা যায়। বনাঞ্চলটি বাংলাদেশের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস। তবে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, বন ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে। তাই পরিবেশবিদরা পাহাড় রক্ষায় সচেতন ভ্রমণ ও ইকো-ট্যুরিজমকে উৎসাহিত করছেন।
স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতি
তাজিংডং এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বম, মারমা, ম্রো, খুমি, ত্রিপুরা ও চাকমা সম্প্রদায় অন্যতম। তাদের নিজস্ব ভাষা, পোশাক, উৎসব ও ধর্মীয় বিশ্বাস পাহাড়ি সংস্কৃতির বিশেষ পরিচয় বহন করে। তাদের ঐতিহ্যবাহী বান্না উৎসব, বাঁশের বাঁশি, হাতের তৈরি পোশাক এবং পাহাড়ি খাবার পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।
উপসংহার
তাজিংডং শুধু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় নয়— এটি আমাদের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। পাহাড়টি যেমন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সৌন্দর্যকে উজ্জ্বল করেছে, তেমনি দেশের পর্যটন শিল্পকেও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন— এই দুটি লক্ষ্য নিয়েই তাজিংডং পাহাড় বাংলাদেশের গর্ব হয়ে থাকবে চিরকাল।