চর্যাপদ কী? চর্যাপদের উৎপত্তি ও ইতিহাসের জন্মকথা
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ হলো প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এটি কেবল সাহিত্যের সূচনা নয়, বরং বাংলা ভাষার বিকাশ ও আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রথম লিখিত প্রকাশ। চর্যাপদকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের সূতিকাগার, কারণ এখান থেকেই বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রূপের উন্মেষ ঘটে।
চর্যাপদ কী
“চর্যা” শব্দের অর্থ হলো অনুশীলন বা সাধনা, আর “পদ” অর্থ স্তব বা গীত। সুতরাং চর্যাপদ বলতে বোঝায় বৌদ্ধ ধর্মীয় সাধকদের লেখা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গান, যেখানে জীবনের গভীর দর্শন, মুক্তি, প্রেম ও মানবতার বার্তা প্রতীকী ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। এই পদগুলো রচিত হয়েছিল সহজযান ও বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শনের ওপর ভিত্তি করে।
চর্যাপদের ভাষা কাব্যধর্মী, ছন্দোবদ্ধ এবং প্রতীকমূলক। এগুলো সাধারণ মানুষের ভাষায় লেখা হলেও গভীর দার্শনিক চিন্তা বহন করে, যা কেবল সাধনার মাধ্যমে উপলব্ধি করা সম্ভব।
রচনাকাল ও ঐতিহাসিক পটভূমি
গবেষকরা মনে করেন, চর্যাপদ রচিত হয়েছিল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে। সে সময় বাংলার সমাজজীবনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব প্রবল ছিল। বজ্রযান ও সহজযান বৌদ্ধ ধর্মমতের অনুসারীরা আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য অন্তর্দর্শনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এই সাধনার ফলাফলই ছিল চর্যাপদ, যেখানে তাঁরা আত্মার মুক্তি ও নৈতিক জীবনের সত্য প্রকাশ করেছেন কাব্যিক ভঙ্গিতে।
চর্যাপদের যুগে বাংলা ভাষা তখনো গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। তাই এতে প্রাচীন আপভ্রংশ বাংলা, পালি, এবং সংস্কৃত ভাষার সংমিশ্রণ দেখা যায়। এই মিশ্র ভাষাই পরে রূপ নেয় মধ্যযুগীয় বাংলায়।
চর্যাপদের রচয়িতা
চর্যাপদের কবিদের বলা হয় সিদ্ধাচার্য, অর্থাৎ সিদ্ধ সাধক। মোট ৩৮ জন সিদ্ধাচার্য প্রায় ৫০টি চর্যা রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন —
-
লুইপা – চর্যাপদের প্রাচীনতম কবি।
-
সরহপা – বৌদ্ধ ধর্মের সহজযান ভাবধারার প্রচারক।
-
কাহ্নপা – প্রেম ও আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রতীকী কবি।
-
শবরপা, ভুসুকুপা, কুক্কুরিপা – মানবজীবনের দুর্বলতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন।
তাঁরা প্রত্যেকে ধর্মীয় দর্শনের গভীর সত্যকে সাধারণ মানুষের ভাষায় কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
ভাষা ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য
চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপ, যা আপভ্রংশ বাংলা বা প্রাক-আধুনিক বাংলা নামে পরিচিত। এই ভাষায় সংস্কৃত, পালি ও মাগধী প্রাকৃতের শব্দরীতি একত্রে মিশে আছে।
চর্যাপদের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—
-
কাব্যধর্মী ছন্দ, লয় ও সুরের ব্যবহার।
-
প্রতীকী ভাষার প্রয়োগ; যেমন “পাখি”, “নৌকা”, “সাগর”, “পথিক” ইত্যাদি শব্দ আধ্যাত্মিক রূপক হিসেবে ব্যবহৃত।
-
মানবজীবনের কষ্ট, প্রেম, মুক্তি ও ঈশ্বরপ্রেমের প্রকাশ।
-
ধর্মীয় অনুভূতির পাশাপাশি সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
-
সহজ, ছন্দোময় ও সংগীতধর্মী প্রকাশভঙ্গি।
এই কারণে চর্যাপদকে কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, বরং বাংলা গীতিকাব্যের সূচনা হিসেবে ধরা হয়।
ধর্মীয় ও দার্শনিক তাৎপর্য
চর্যাপদ মূলত বজ্রযান ও সহজযান বৌদ্ধ ধর্মের দর্শনের ভিত্তিতে রচিত। এতে বাহ্যিক আচার নয়, বরং অন্তর্দর্শন ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মুক্তি লাভের পথ নির্দেশ করা হয়েছে।
কবিরা “গুরু” বা “শিক্ষক”-এর প্রতি ভক্তি, মানবজীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব, কামনা থেকে মুক্তি এবং আত্মার জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। চর্যাগুলোতে রূপক ভাষায় বলা হয়েছে—
“মন হলো নৌকা, শরীর সেই সাগর, আর জ্ঞান হলো বৈঠা— এই তিনের সমন্বয়ে মুক্তির তীর পাওয়া যায়।”
এইভাবে চর্যাপদ আধ্যাত্মিক মুক্তি ও মানবতার চেতনার মিলন ঘটিয়েছে।
চর্যাপদের আবিষ্কার
চর্যাপদের পুঁথিটি ১৯০৭ সালে বিখ্যাত পণ্ডিত ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্থাগারে আবিষ্কার করেন। পুঁথিটি ছিল তালপাতায় লেখা এবং এতে ৫০টি পদ সংরক্ষিত ছিল, যদিও কিছু পদ অসম্পূর্ণ।
এই আবিষ্কার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা, কারণ এটি প্রমাণ করে যে বাংলা ভাষার লিখিত ঐতিহ্য এক সহস্রাব্দ পুরোনো। বর্তমানে চর্যাপদের পাণ্ডুলিপিটি নেপালের জাতীয় আর্কাইভসে (National Archives of Nepal) সংরক্ষিত রয়েছে।
চর্যাপদের সাহিত্যিক গুরুত্ব
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের বিকাশের প্রথম ধাপ। এর মাধ্যমে—
-
বাংলা ভাষা লিখিত রূপ লাভ করে।
-
গীতিকবিতার সূচনা ঘটে।
-
বৌদ্ধ ধর্মীয় ভাবধারা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
-
ধর্ম, সমাজ ও মানবজীবনের গভীর মূল্যবোধ একত্রে প্রকাশিত হয়।
চর্যাপদের পদগুলো আজও সাহিত্য, সংগীত ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত। এটি প্রমাণ করে যে বাংলা সাহিত্য কেবল বিনোদনের নয়, বরং জীবনের অর্থ খোঁজার এক গভীর অনুসন্ধান।
চর্যাপদের ভাষা থেকে আধুনিক বাংলা
চর্যাপদের ভাষা থেকেই ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার পরবর্তী রূপ গঠিত হয়। আপভ্রংশ ভাষার এই কাব্যধর্মী রূপ থেকেই মধ্যযুগে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, ও বরেন্দ্রী সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।
চর্যাপদের পদগুলো দেখায় যে বাংলার ভাষা কোনো আকস্মিক সৃষ্টি নয়, বরং দীর্ঘ সাধনার ফল। এই ধারা অব্যাহত থেকে আজকের আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত তৈরি করেছে।
উপসংহার
চর্যাপদ শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন নয়, এটি বাঙালি জাতিসত্তার উৎস ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যের মূলভিত্তি। এতে যেমন ধর্মীয় চেতনা আছে, তেমনি মানবতার সার্বজনীন বার্তাও রয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস বুঝতে হলে চর্যাপদকে জানা অপরিহার্য। কারণ এখান থেকেই শুরু হয় বাঙালির ভাষা, চিন্তা, ধর্ম ও কাব্যিক আত্মার যাত্রা।
চর্যাপদই প্রমাণ করে—
“বাংলা ভাষার জন্ম সাহিত্য থেকেই, আর সেই সাহিত্যের প্রথম আলো হলো চর্যাপদ।”