অর্থ কি, অর্থ কাকে বলে?

অর্থ মানবজীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান। সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ বিনিময়ের মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয় দ্রব্য বা সেবা সংগ্রহ করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে বিনিময় প্রক্রিয়া জটিল হয়ে ওঠে, এবং মানুষ একটি সাধারণ মাধ্যমের প্রয়োজন অনুভব করে যা দ্বারা দ্রব্য ও সেবার আদান-প্রদান সহজ হয়। সেই প্রয়োজন থেকেই অর্থের উদ্ভব। অর্থ শুধু পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম নয়, এটি সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাণশক্তি।
অর্থের সংজ্ঞা
অর্থ এমন এক বস্তু বা উপকরণ যা বিনিময়ের মাধ্যম, মূল্যের পরিমাপক, এবং সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে। সহজভাবে বললে, অর্থ হলো সেই সাধারণ মাধ্যম যার সাহায্যে আমরা দ্রব্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় করি এবং যা সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে।
অর্থের উৎপত্তি ও বিকাশ
প্রথমে মানুষ বাটার সিস্টেম বা পণ্য বিনিময় পদ্ধতির মাধ্যমে লেনদেন করত। উদাহরণস্বরূপ, একজন কৃষক তার ধান দিয়ে অন্যজনের কাছ থেকে কাপড় নিত। কিন্তু এই ব্যবস্থায় একাধিক সমস্যা দেখা দেয়—যেমন, উভয়ের প্রয়োজন এক না-ও হতে পারে, মূল্য নির্ধারণ কঠিন হতো, এবং বড় পরিমাণ দ্রব্য বহন করা অসুবিধাজনক ছিল।
এই জটিলতা দূর করতেই মানুষ ধীরে ধীরে মুদ্রা বা অর্থের ব্যবহার শুরু করে। প্রথমে শাঁস, পশুর চামড়া, ধাতুর টুকরো ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। পরে ধীরে ধীরে স্বর্ণ, রৌপ্য, কাগজের টাকা ও আধুনিক ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন ঘটে।
অর্থের প্রধান কার্যাবলি
অর্থ সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে—
-
বিনিময়ের মাধ্যম: অর্থের সবচেয়ে মৌলিক ভূমিকা হলো এটি সকল প্রকার পণ্য ও সেবার বিনিময়ে গ্রহণযোগ্য। অর্থ থাকলে যেকোনো দ্রব্য সহজে কেনা যায়।
-
মূল্যের পরিমাপক: অর্থের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ সহজ হয়। যেমন, একটি বইয়ের দাম ৩০০ টাকা বলা মানেই বইটির মূল্য নির্দিষ্ট হয়েছে।
-
সঞ্চয়ের বাহন: অর্থ মানুষকে ভবিষ্যতের প্রয়োজনের জন্য সঞ্চয় করার সুযোগ দেয়। এতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েই আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করে।
-
পেমেন্টের মাধ্যম: বিভিন্ন ঋণ, বিল, বা মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রেও অর্থ ব্যবহৃত হয়।
-
অর্থনৈতিক হিসাবের একক: অর্থ সব লেনদেনের মান পরিমাপের একটি একক হিসেবে কাজ করে, যা হিসাব রাখাকে সহজ করে তোলে।
অর্থের প্রকারভেদ
সময়ের সঙ্গে অর্থের বিভিন্ন রূপের উদ্ভব হয়েছে—
-
বস্তু অর্থ (Commodity Money): যেমন সোনা, রূপা, লবণ, পশু ইত্যাদি।
-
ধাতব অর্থ (Metallic Money): তামা, রূপা, সোনার মুদ্রা।
-
কাগজের অর্থ (Paper Money): সরকারের মুদ্রিত নোট, যা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত।
-
ঋণ অর্থ (Credit Money): ব্যাংক নোট, চেক, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি।
-
ডিজিটাল অর্থ (Digital or Electronic Money): মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট, ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি আধুনিক রূপ।
অর্থের গুরুত্ব
অর্থ ছাড়া আধুনিক অর্থনীতি কল্পনাই করা যায় না। এটি—
-
মানবজীবনের প্রাথমিক চাহিদা পূরণে সহায়ক।
-
উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
-
বাণিজ্য, শিল্প ও বিনিয়োগের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্থিতি ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থের ভূমিকা
অর্থ একদিকে বিনিময়ের মাধ্যম, অন্যদিকে এটি মূলধন সঞ্চয়ের উৎস। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণের প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আধুনিক যুগে অর্থ শুধুমাত্র টাকার কাগজ নয়, বরং এটি একটি অর্থনৈতিক শক্তি ও সামাজিক সম্পর্কের প্রতীক।
অর্থ ও সমাজ
অর্থ সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং পারস্পরিক নির্ভরতা সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের জীবনমান উন্নত হয়। তবে অতিরিক্ত অর্থলিপ্সা সমাজে অসাম্য ও অনৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই অর্থের ব্যবহার হতে হবে বিবেকবান ও ন্যায্যভাবে।
উপসংহার
সবশেষে বলা যায়, অর্থ কেবল বিনিময়ের মাধ্যম নয়; এটি মানবসভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম চালিকা শক্তি। সঠিকভাবে অর্থের ব্যবহারই সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ন্যায়সঙ্গত বণ্টনই হতে পারে একটি সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক জীবনের ভিত্তি।