রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার তরী” বাংলা কবিতার এক অসাধারণ রূপক কাব্য, যেখানে কবি জীবনের মূল্য, শ্রম, ও আত্মত্যাগের ভাবকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত, যা এর সুরেলা গতি ও ছন্দময় ভাবপ্রকাশকে অনন্য করেছে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি চরণে নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রা থাকে, এবং এই ছন্দের সৌন্দর্য শব্দের মাধুর্য ও তাল-লয়ের ভারসাম্যে গড়ে ওঠে। নিচে এ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো তুলে ধরা হলো—
-
কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ: “সোনার তরী” কবিতাটি একই নামের কাব্যগ্রন্থ ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত) থেকে নেওয়া।
-
ছন্দের ধরন: কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। এই ছন্দে প্রতিটি চরণে নির্দিষ্ট মাত্রা (সাধারণত ১৪ বা ১৬) থাকে, যেখানে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে ধ্বনিমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
-
ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
-
প্রতিটি পঙ্ক্তি নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রায় বিভক্ত।
-
শব্দের তাল, গতি, ও ধ্বনি-মাধুর্যের ওপর জোর দেওয়া হয়।
-
এই ছন্দে উচ্চারণের সুর ও গতিশীলতা কবিতাকে সঙ্গীতধর্মী করে তোলে।
-
-
উদাহরণ: “সোনার তরী” কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি—
“হে সোনার তরী, আমি তোমায় দেখেছি পাড়ি দিতে।”
এই চরণে ১৪ মাত্রা রয়েছে, যা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের নিয়ম মেনে চলে। -
ছন্দ নির্বাচন: রবীন্দ্রনাথ এই ছন্দটি বেছে নিয়েছিলেন মূলত এর সুরেলা সৌন্দর্য ও আবেগ প্রকাশের সহজতার জন্য। তাঁর অনেক গীতিকবিতা, যেমন “বসন্তে ফুলে ফুলে” বা “আমার সোনার বাংলা”, একইভাবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
-
অর্থ ও ভাব: “সোনার তরী” কবিতায় কবি জীবনের পরিশ্রম ও অর্জনের ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে ‘সোনার তরী’ ব্যবহার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ জীবনের স্বর্ণসম ধন সংগ্রহ করে, কিন্তু মৃত্যুর স্রোতে তা ত্যাগ করতেই হয়।
-
কাব্যের প্রেক্ষাপট: এই কাব্য রচিত হয় কবির যুবক বয়সে, যখন তিনি জীবনের অনিত্যতা ও কর্মের মূল্য নিয়ে ভাবছিলেন। তাই ছন্দের মাধুর্য ও ভাবের গভীরতা মিলিয়ে কবিতাটি কাব্যজগতে এক অনন্য সৃষ্টি হয়ে ওঠে।
-
ছন্দের সঙ্গে ভাবের সম্পর্ক: মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মসৃণ প্রবাহ কবির অন্তর্গত ভাবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে চলেছে। যেমন তরীর গতি স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে, তেমনি কবিতার ছন্দও আবেগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে।
-
বাংলা কবিতায় প্রভাব: “সোনার তরী”র মতো কবিতাগুলো বাংলা কাব্যে ছন্দ ব্যবহারের এক নতুন ধারা তৈরি করে। পরে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্তসহ অনেক কবি এই ছন্দে কবিতা লিখে বাংলা কবিতার ছন্দরীতি সমৃদ্ধ করেছেন।
সব মিলিয়ে, “সোনার তরী” কবিতার ছন্দ মাত্রাবৃত্ত হওয়ায় এর ধ্বনি, রূপ ও ভাবের এক নিখুঁত সামঞ্জস্য গড়ে উঠেছে। এই ছন্দই কবিতাকে দিয়েছে ছন্দময় সুর, সঙ্গীতধর্মী সৌন্দর্য এবং গভীর মানসিক অনুরণন।