বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এক অনন্য সাহসিকতার প্রতীক। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম দিকে বীরত্বের সঙ্গে জীবন উৎসর্গ করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁর নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে। তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে জাতিকে সাহস, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের এক মহান উদাহরণ উপহার দেন।
মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ৮ মে ফেনী জেলার মুজিবনগর (বর্তমানে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার সালামতপুর গ্রাম) এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮ নম্বর ব্যাটালিয়নের একজন সিপাহী হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি চট্টগ্রামের হিলি ও বরকলা অঞ্চলের লালমনিরহাটের চাঁদপাই এলাকায় অবস্থানরত শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেন। শত্রু বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকলেও মুন্সী আব্দুর রউফ নিজের দায়িত্ব থেকে এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটেননি।
তিনি একা একটি মেশিনগান পজিশন থেকে শত্রুদের ওপর নির্ভুল ও প্রবল গুলি বর্ষণ করেন। তাঁর সাহসিকতায় শত্রু বাহিনী সাময়িকভাবে পিছু হটে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার ও রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে তাঁর অবস্থানে প্রবল আক্রমণ চালায়। তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুলি চালিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং সেই যুদ্ধে শত্রুর গোলার আঘাতে শহীদ হন। তাঁর অটল মনোবল ও ত্যাগের কারণে মুক্তিবাহিনী সেই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
মুন্সী আব্দুর রউফের এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে এক অমূল্য অবদান রেখে যায়। তাঁর বীরত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধে নতুন উদ্দীপনা পায়। রাষ্ট্র তাঁর অনন্য সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করে, যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান।
তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফেনী জেলার তাঁর জন্মভূমিতে ও বরকলা এলাকায় তাঁর নামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে তিনি শুধু এক বীর সৈনিক নন, বরং এক অমর প্রতীক, যিনি শেখান—দেশের জন্য জীবন উৎসর্গই সর্বোচ্চ ত্যাগ।
মুন্সী আব্দুর রউফের জীবন থেকে শেখার বিষয় হলো, দেশপ্রেম মানে নিঃস্বার্থভাবে দেশের মাটির প্রতি দায়িত্ব পালন করা। তাঁর সাহস ও আত্মত্যাগ প্রমাণ করে যে, একটি মানুষের দৃঢ় মনোবল ও ভালোবাসা পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে মুন্সী আব্দুর রউফের নাম সর্বদা অমর হয়ে থাকবে।