বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন দেশের স্থাপত্য ইতিহাসে এক অনন্য সৃষ্টি, যা শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং জাতির গৌরব ও গণতন্ত্রের প্রতীক। এটি ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সংসদ ভবন কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। বিশাল আয়তনের এই স্থাপনা ও এর চারপাশের মনোরম পরিবেশ বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন মোট ২১৫ একর জমির উপর নির্মিত, যা ভবনের গঠন, উদ্যান, লেক এবং অন্যান্য সহায়ক স্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন করেন মার্কিন স্থপতি লুই আই. কাহন (Louis I. Kahn), যিনি আধুনিক স্থাপত্যের ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। তাঁর নকশায় জ্যামিতিক নকশা, আলো ও বাতাসের প্রাকৃতিক ব্যবহার, এবং সরলতার সঙ্গে মহিমার এক অনন্য ভারসাম্য দেখা যায়। এই ভবনের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে এবং শেষ হয় স্বাধীনতার পর, ১৯৮২ সালে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ চললেও প্রতিটি ধাপেই স্থাপত্যগত নিখুঁততা বজায় রাখা হয়, যা ভবনটিকে আজ একটি স্থাপত্যের শিল্পকর্মে পরিণত করেছে।
২১৫ একর জমির মধ্যে শুধু মূল সংসদ ভবনই নয়, বরং আছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মধ্যে প্রধান সংসদ ভবন অবস্থিত প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে। বাকি জমিতে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ, উদ্যান, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা, মসজিদ, ক্লাব, অফিস ভবন এবং অতিথিশালা। পুরো এলাকাটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে প্রাকৃতিক আলো, বায়ু চলাচল এবং পরিবেশের সঙ্গে স্থাপত্যের এক সুষম সামঞ্জস্য বজায় থাকে।
এই ভবনের চারপাশে বিস্তৃত লেকটি কেবল সৌন্দর্য বাড়ায় না, বরং ভবনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে। ভবনের মূল কাঠামোতে ব্যবহৃত হয়েছে সাদা কংক্রিট ও প্রাকৃতিক পাথর, যা সময়ের সঙ্গে রঙে পরিবর্তন এনে এক প্রাকৃতিক ছোঁয়া দেয়। ভেতরে রয়েছে বৃহৎ সংসদ কক্ষ, বিভিন্ন দপ্তর, লাইব্রেরি, সাংবাদিক গ্যালারি, এবং কমিটির কক্ষসমূহ। সব কক্ষ এমনভাবে নির্মিত যে প্রাকৃতিক আলো পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রবেশ করতে পারে।
জাতীয় সংসদ ভবন শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং এটি বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। লুই কাহনের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি দেয়াল, ছিদ্র, জানালা এবং ছাদের বিন্যাসে গণতন্ত্রের উন্মুক্ততা ও স্বচ্ছতার প্রতীকী অর্থ প্রকাশ পেয়েছে। এই ভবনটিকে বিশ্বের অনেক স্থপতি “আধুনিক স্থাপত্যের বিস্ময়” বলে অভিহিত করেছেন।
সবশেষে বলা যায়, ২১৫ একর জমির উপর নির্মিত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন কেবল একটি প্রশাসনিক স্থাপনা নয়; এটি এক ঐতিহাসিক নিদর্শন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যকলার সম্মিলিত প্রতিফলন হিসেবে চিরকাল জাতির গর্ব হয়ে থাকবে।