আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দল, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে পরিণত হয়। এই দলের প্রাথমিক সংগঠন গঠনে কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। তিনি তৎকালীন পূর্ববাংলার রাজনীতিতে এক দূরদর্শী সংগঠক ও চিন্তাশীল নেতা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
শামসুল হক মূলত মুসলিম লীগের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি বুঝতে পারেন যে, পূর্ববাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার রক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এবং তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করেন। ফলস্বরূপ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সভায় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” প্রতিষ্ঠিত হয়।
দলের প্রাথমিক কাঠামো গঠনের সময় সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, আর সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। তার সাংগঠনিক দক্ষতা এবং জনসংযোগের ক্ষমতার কারণে দলটি দ্রুতই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। শামসুল হক দলের নীতিনির্ধারণ, সদস্য সংগ্রহ এবং রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শুধুমাত্র ধর্মীয় আদর্শ নয়, জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিই হওয়া উচিত রাজনীতির মূল লক্ষ্য।
দলটির নামের সঙ্গে “মুসলিম” শব্দটি যুক্ত থাকলেও শামসুল হক শুরু থেকেই এটিকে একটি জনভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে দলটির নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং নামকরণ করা হয় “আওয়ামী লীগ”। এই পরিবর্তনের পেছনে শামসুল হকের আদর্শিক প্রভাবও ছিল গভীর, কারণ তিনি রাজনীতিকে ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে এনে সর্বজনীন জনগণের আন্দোলন হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী রাজনীতিক, যিনি একদিকে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হন, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতেও নিজের মতামত স্পষ্টভাবে তুলে ধরতেন। তার অবদানের ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ পাকিস্তানের প্রাথমিক পর্যায়ের বিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং পরবর্তীকালে পূর্ববাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে।
সুতরাং, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক, যিনি দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি স্থাপন, নীতিনির্ধারণ এবং রাজনৈতিক আদর্শ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর এই অবদানই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপণের পথ সুগম করে দেয়।