বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রাম ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মভূমি এই ভাষা আন্দোলন থেকেই প্রস্তুত হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই যখন শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়, তখনই বাঙালি জাতি তার মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনে নেমে পড়ে। এই আন্দোলনের প্রাথমিক সাংগঠনিক রূপ ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, যা গঠিত হয় ১৯৪৭ সালে।
দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে দুটি অংশ—পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান—ভৌগোলিকভাবে অনেক দূরে ছিল। জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলাভাষী হলেও শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা নেয়। এর ফলে ভাষার প্রশ্নে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় বাঙালিদের মধ্যে। সেই অসন্তোষ থেকেই সচেতন ছাত্র-নেতারা বুঝতে পারেন, মাতৃভাষা রক্ষার জন্য একটি সংগঠিত আন্দোলনের প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও তরুণ বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জনমত সৃষ্টি এবং সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ সংগঠিত করা।
গঠনের শুরুতে পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা নুরুল হক ভুঁইয়া, আব্দুল মতিন, রফিকুল ইসলাম, শামসুল হক, এবং কাজী গোলাম মহব্বতসহ আরও অনেকে। তাঁরা ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দেন। এই পরিষদই পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম কাজ ছিল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে একত্রিত করা এবং সরকারের নীতির বিরুদ্ধে যুক্তিনির্ভর প্রতিবাদ গড়ে তোলা। পরিষদ সভা, প্রচারপত্র ও আলোচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বোঝাতে থাকে। এভাবেই আন্দোলনের বীজ বপন হয় যা ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকায় এসে বলেন, “উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা,” তখন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এই সময় থেকেই আন্দোলন ব্যাপকতা পেতে শুরু করে। পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় এই পরিষদ ভেঙে আবার নতুন নামে সংগঠিত হয়, যেমন ‘তমদ্দুন মজলিশ’ ও ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (নবগঠিত)’, যা ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণ মাত্রায় আন্দোলন গড়ে তোলে।
অতএব, ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ প্রথম গঠিত হয় ১৯৪৭ সালে, যা বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের ভিত্তি সংগঠন হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এই পরিষদই পরবর্তী আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে।
চূড়ান্তভাবে বলা যায়, বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার যে ইতিহাস আজ গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তার মূল সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের এই সংগঠন গঠনের মাধ্যমে—যেখানে ছাত্রসমাজের অদম্য সাহস, দেশপ্রেম এবং মাতৃভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা এক নতুন যুগের সূচনা ঘটায়।