প্রবাসের দিনগুলি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আত্মজৈবনিক রচনা, যার লেখিকা জাহানারা ইমাম। এই গ্রন্থটি বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হিসেবে পরিচিত। এতে লেখিকা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, প্রবাসজীবনের বাস্তবতা এবং দেশের প্রতি গভীর টানকে হৃদয়স্পর্শীভাবে তুলে ধরেছেন। বইটি শুধু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, বরং তা এক জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতিফলনও বটে।
এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে লেখিকার প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা ও তাঁর দেশপ্রেমের গভীর প্রকাশ। তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন, কিন্তু দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ও জাতির দুর্দশা তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। জাহানারা ইমাম তাঁর লেখায় প্রকাশ করেছেন কেমন করে একজন মা, একজন শিক্ষক এবং একজন দেশপ্রেমিক নারী দূরদেশে থেকেও নিজের মাটির প্রতি অবিচল ভালোবাসা ধরে রেখেছিলেন।
গ্রন্থটিতে লেখিকা সহজ ও প্রাণবন্ত ভাষায় নিজের চারপাশের জীবনের বিবরণ দিয়েছেন। প্রবাসে থাকা অবস্থায় তিনি যেভাবে বাংলাদেশের খবর রাখতেন, দেশমাতৃকার জন্য উদ্বিগ্ন হতেন, এবং নিজের মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট অনুভব করতেন—তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে উঠে এসেছে। তাঁর লেখায় দেশপ্রেম, মাতৃত্ববোধ, মানবিকতা ও আত্মত্যাগের বার্তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
এই গ্রন্থে লেখিকার জীবনের নানা ঘটনার পাশাপাশি পাঠক বুঝতে পারে, কীভাবে প্রবাসের একঘেয়ে জীবন একজন সংবেদনশীল মানুষকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি শুধু নিজের অনুভূতিই প্রকাশ করেননি, বরং প্রবাসে থাকা হাজারো বাঙালির হৃদয়ের কথাও বলেছেন। লেখিকার ভাষা সহজ, স্পষ্ট এবং আবেগপূর্ণ, যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
‘প্রবাসের দিনগুলি’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করেছে কারণ এটি একাধারে আত্মজৈবনিক সাহিত্য, দেশপ্রেমের দলিল এবং প্রবাসজীবনের প্রতিফলন। এই বইয়ের মাধ্যমে জাহানারা ইমাম প্রমাণ করেছেন, সাহিত্য কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি হতে পারে ইতিহাসের সাক্ষী ও আবেগের বাহক।
জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের সাহিত্য ও সমাজে একজন প্রভাবশালী নারী হিসেবে পরিচিত। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের নৃশংসতা ও শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে পরবর্তীতে লেখেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’, যা তাঁর সর্বাধিক পরিচিত রচনা। তবে ‘প্রবাসের দিনগুলি’ তাঁর মানসিক বিকাশ, চিন্তাধারা ও লেখনীশক্তির পূর্বসূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
সর্বোপরি বলা যায়, ‘প্রবাসের দিনগুলি’ কেবল একটি আত্মজীবনী নয়; এটি একজন নারীর দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও আবেগের জীবন্ত দলিল। এই কারণে এর রচয়িতা জাহানারা ইমাম-এর নাম বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।