বাংলা ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। এর শিকড় প্রাচীন ভারতের সাধারণ মানুষের মুখে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষাগুলিতে নিহিত। প্রাকৃত ছিল সংস্কৃতের তুলনায় সহজ, লোকজ ও স্বাভাবিক ভাষা। সময়ের বিবর্তনে প্রাকৃত ভাষা থেকে অপভ্রংশ, তারপর আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষাগুলির জন্ম হয়, যার মধ্যে বাংলা একটি প্রধান ভাষা।
প্রাকৃত ভাষার সংজ্ঞা: প্রাকৃত শব্দের অর্থ ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃতিক’। এটি প্রাচীন ভারতীয় সাধারণ জনগণের মুখের ভাষা ছিল, যা সংস্কৃতের কঠোর ব্যাকরণনির্ভর কাঠামোর বিপরীতে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজ।
-
ভাষাপরিবার: প্রাকৃত ভাষাগুলি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের ইন্দো-ইরানীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত ইন্দো-আর্য শাখার অংশ।
-
সংস্কৃতের সঙ্গে সম্পর্ক: প্রাকৃত ভাষা সংস্কৃতের সরল ও লোকজ রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়। যেখানে সংস্কৃত ছিল শিক্ষিত শ্রেণির ভাষা, সেখানে প্রাকৃত ছিল সাধারণ মানুষের ভাষা।
-
প্রাকৃত ভাষার ধরন: প্রাকৃতের বিভিন্ন উপভাষা ছিল—মাগধী, শৌরসেনী, মহারাষ্ট্রী, অর্ধমাগধী ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিটির ভিত্তিতেই বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় ভাষার জন্ম হয়েছে।
-
বাংলা ভাষার উৎস: মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। সময়ের ধারায় এটি অপভ্রংশ পর্যায় অতিক্রম করে আধুনিক বাংলায় রূপ নেয়।
-
অপভ্রংশ পর্যায়: প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশ ভাষার উদ্ভব ঘটে যখন শব্দগঠন, উচ্চারণ ও ব্যাকরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। এই পর্যায়েই আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষার ভিত গড়ে ওঠে।
-
বাংলা ভাষার বিবর্তন ধারা:
-
সংস্কৃত → প্রাকৃত → অপভ্রংশ → বাংলা
এই ধারা ভাষার প্রাকৃতিক বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন।
-
-
অন্য ভাষার উৎপত্তি: মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া ও বিহারী ভাষা; শৌরসেনী প্রাকৃত থেকে হিন্দি ও পাঞ্জাবি; মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত থেকে মারাঠি ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
-
পালি ভাষার ভূমিকা: পালি ভাষা ছিল বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের ভাষা, যা প্রাকৃতেরই একটি শাখা। এটি বাংলার প্রাথমিক সাহিত্য বিকাশে পরোক্ষ প্রভাব ফেলেছিল।
-
প্রাকৃতের গুরুত্ব: প্রাকৃত ভাষা শুধু বাংলা নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ভাষাগুলির ভিত্তি স্থাপন করেছে। এটি ইতিহাসে সংস্কৃতের চেয়ে বেশি বাস্তব জীবন ও মানুষের মুখের কথার প্রতিনিধিত্ব করেছে।
সুতরাং, স্পষ্টভাবে বলা যায় যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি প্রাকৃত ভাষা থেকে, বিশেষত মাগধী প্রাকৃত থেকে। সময়ের বিবর্তনে এটি অপভ্রংশ হয়ে ক্রমান্বয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার রূপ লাভ করে, যা আজ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ ও বিশ্বস্বীকৃত ভাষা।