পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে যুক্তফ্রন্ট গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তান শাসনের অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতীক।
যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি শক্তিশালীভাবে প্রকাশ করে। এই জোটের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলা এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা।
এখন নিচে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মূল পটভূমি, গঠনপদ্ধতি, নেতৃত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো—
• গঠনের সিদ্ধান্ত:
১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খিলাফত দল একত্র হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় পূর্ব বাংলার প্রতি অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধেই এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
• আনুষ্ঠানিক গঠন:
চূড়ান্তভাবে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ, শের-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খিলাফত দল একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।
• গঠনকারী দলসমূহের ভূমিকা:
আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল বাহন হিসেবে কাজ করে।
কৃষক শ্রমিক পার্টি, শের-ই-বাংলার নেতৃত্বে, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেয়।
পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল মধ্যবিত্ত ও নাগরিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।
খিলাফত দল ধর্মীয় নৈতিক মূল্যবোধকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরে।
• নেতৃত্ব ও মূল ব্যক্তিত্ব:
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন যুক্তফ্রন্ট গঠনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। শের-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক ঐক্য গঠনে নির্ধারক।
• গঠনপটভূমি:
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা এবং রাজনৈতিক অধিকার হরণ পূর্ব বাংলার জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বুঝতে পারে, বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করে সাফল্য সম্ভব নয়। তাই ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন ছিল—যার ফলশ্রুতিতেই যুক্তফ্রন্টের জন্ম।
• গঠনকালীন ঘোষণাপত্র:
যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে, যেখানে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভাষার স্বীকৃতি, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার, শিক্ষার প্রসার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়।
• রাজনৈতিক প্রভাব:
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে, যা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনে। এটি প্রমাণ করে যে পূর্ব বাংলার জনগণ নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ এবং তাদের দাবি অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
• গঠন-পরবর্তী ফলাফল:
যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবুও এটি পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক চেতনা, আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করে। এই ঐক্যই পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
সংক্ষেপে, ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গঠিত যুক্তফ্রন্ট ছিল পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক মুক্তির অন্যতম ভিত্তি। এটি শুধু একটি জোট নয়, বরং বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার প্রথম সুশৃঙ্খল রূপকল্প।