বাংলা গদ্যের প্রকৃত ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর লেখনী ছিল সহজ, প্রাঞ্জল এবং যুক্তিনির্ভর। সেই সময়ে বাংলা ভাষা সংস্কৃতনির্ভর ও জটিল ছিল, কিন্তু বিদ্যাসাগর সেই কৃত্রিমতা ভেঙে গদ্যকে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে তোলেন। এজন্যই তাঁকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। তাঁর রচনায় যেমন ভাষার পরিশুদ্ধতা রয়েছে, তেমনি বোধগম্যতারও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তাঁর অবদানের মূল দিকগুলো হলো—
-
গদ্যরীতির সংস্কার: বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা গদ্য অতিমাত্রায় সংস্কৃতনির্ভর ছিল, যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য ছিল না। তিনি গদ্যের ভাষাকে সরল, প্রাকৃতিক ও ব্যবহারযোগ্য করে তোলেন। এতে বাংলা গদ্যের নতুন যুগের সূচনা হয়।
-
শিক্ষাব্যবস্থায় অবদান: তিনি শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে বহু পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, যেমন— বর্ণপরিচয়, বোধোদয় প্রভৃতি। এসব বই বাংলা ভাষাকে সহজভাবে শেখার পথ সুগম করে দেয়।
-
সংস্কারমূলক চিন্তা: বিদ্যাসাগর শুধু ভাষার সংস্কারক নন, সমাজসংস্কারকও ছিলেন। তাঁর লেখায় যুক্তি, মানবতা ও নৈতিকতার প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর লেখনীর ভাষা ছিল স্পষ্ট ও যুক্তিনিষ্ঠ, যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
-
প্রাচীন ও আধুনিক গদ্যের সেতুবন্ধন: বিদ্যাসাগরের লেখায় একদিকে রয়েছে সংস্কৃতের শৃঙ্খলা, অন্যদিকে রয়েছে বাংলার স্বাভাবিক প্রবাহ। এই সংমিশ্রণ বাংলা গদ্যকে একটি সুগঠিত রূপ দেয়।
-
সাহিত্যিক প্রভাব: তাঁর গদ্যশৈলী পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথের মতো সাহিত্যিকদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলা গদ্যের বিবর্তনে বিদ্যাসাগরই প্রথম দৃঢ় ভিত্তি নির্মাণ করেন।
-
ভাষার শুদ্ধতা ও ছন্দ: তাঁর গদ্যে একটি প্রাকৃতিক ছন্দ রয়েছে। তিনি অপ্রয়োজনীয় শব্দ পরিহার করে বাক্যগঠনকে সরল রেখেছিলেন, যা পাঠকের কাছে ভাষাকে জীবন্ত করে তোলে।
সব মিলিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে শুধু গঠনগতভাবে সমৃদ্ধ করেননি, বরং চিন্তার গভীরতা ও নৈতিক দৃঢ়তাও প্রদান করেছিলেন। তাই তাঁকেই যথার্থভাবে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ বলা হয়।